নয়া মিশনে গার্ডিওলা by ফারজানা আক্তার সাথী

মু-িত মস্তক। কেতাদুরস্ত পোশাকে ডাগ আউটে চঞ্চল পায়চারি। কখনও কখনও গলা উঁচিয়ে মেসি-জাভিদের প্রয়োজনীয় টিপস। ২০০৮ থেকে ২০১২, বার্সিলোনার ডাগ আউটে এমন দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন পেপ গার্ডিওলা।
মাত্র চারটি বছর, এর মধ্যে দলকে জিতেছিলেন ১৪টি শিরোপা (দুটি চ্যাম্পিযন্স লীগ, টানা তিন লা লীগা শিরোপা)। দলকে বানিয়েছিলেন প্রায় ‘অপরাজেয়’। সবচেয়ে বড় কথা মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তাদের মতো খেলোয়াড়দের তিনি বেঁধেছিলেন এক সুতায়। লোকে বলত, বার্সা খেলে ভিনগ্রহের খেলা। তবে পেপের রাজত্বের অবসান হয়েছে গত বছরেই। স্বেচ্ছায় ছেড়েছেন বার্সার চাকরি। লক্ষ্য ছিল একটু বিশ্রাম। তবে তা এক বছরের বেশি হলো না। পরিচিত ঢঙে আবার ডাগ আউটে দেখা যাবে স্পেনিয়ার্ড তারকা এই ফুটবল কোচকে। তবে মেসি, জাভি বা ইনিয়েস্তাদের গুরু হিসেবে নয়। গার্ডিওলা পাড়ি জমিয়েছেন জার্মানিতে। জায়ান্ট বেয়ার্ন মিউনিখের হয়ে আগামী মৌসুমে দেখা যাবে তাঁকে। ডাগ আউটে অস্থির পায়চারি করবেন তখন থমাস মুলার, বাস্তেইন শোয়েনস্টেগার, ফিলিপ লাম, ফ্রাঙ্ক রিবেরিদের সাফল্যের জন্য।
কথা শোনা গিয়েছিল অনেক ক্লাবেরই। টাকার বস্তা নিয়ে প্রস্তুত ছিল ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি, প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনের মতো দলগুলো। তবে শেষ পর্যন্ত সফল জার্মানির বেয়ার্ন মিউনিখ। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর শেষ পর্যন্ত সফল বেয়ার্নই। গত ১৬ জানুয়ারি হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিক চুক্তিও। ৪১ বছর বয়সী গার্ডিওলার সঙ্গে বেয়ার্নের চুক্তিটা তিন বছরের। সেই হিসাবে গার্ডিওলা মিউনিখে থাকবেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এ বছরের জুন মাসে বেয়ার্নের বর্তমান কোচ ৬৭ বছর বয়সী হেইঙ্কসের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে গার্ডিওলা দায়িত্ব নেবেন জার্মানির এই ঐতিহ্যবাহী দলের। শুরু হবে মিউনিখে পেপের নতুন অধ্যায়। গার্ডিওলার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে উচ্ছ্বসিত বেয়ার্ন মিউনিখের প্রধান নির্বাহী কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে বলেছেন, ‘পেপ গার্ডিওলা এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা কোচ। আমি নিশ্চিত তাঁর বেয়ার্নে দায়িত্বে আসা কেবল এই ক্লাবের ফুটবলকেই অন্যমাত্রা যোগ করবে না, তাঁর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে গোটা জার্মান ফুটবলই। আমরা ভীষণ খুশি যে তাঁকে কোচ হিসেবে আনতে পেরেছি।’
খেলোয়াড় ও কোচিং ক্যারিয়ার, গার্ডিওলারÑ সবই শুরু বার্সিলোনা থেকে। আর সে কারণেই বার্সার সঙ্গে গার্ডিওলার সম্পর্ক ছিল আত্মার চেয়েও বেশি। যুব পর্যায়ে বার্সাতে খেলেছেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। এর পরের দুই বছর বার্সার দ্বিতীয় সারির দলে। এরপর টানা ২০০১ সাল পর্যন্ত খেলেছেন মূল দলের হয়ে। তারপর দেশে ও দেশের বাইরে মোট ৫টি ক্লাবে খেলেছেন ডিফেন্সিভ ফুটবলার হিসেবে। ২০০৭-এ নেন বার্সার বি দলের কোচের দায়িত্ব। এক বছর পরই অর্থাৎ ২০০৮ সালে আকস্মিক দায়িত্ব পান বার্সার মূল দলের কোচ হিসেবে। হল্যান্ডের ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড বরখাস্তের পর তার দায়িত্ব গ্রহণ বার্সার জন্য নবযুগেরই আভাস ছিল। অভিষেক মৌসুমেই জেতেন লীগ শিরোপা। শুধু তাই নয়, ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রতিযোগিতা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপাও জেতে বার্সা তাঁর অধীনে। কিংস কাপসহ মোট তিনটি শিরোপা জিতে অভিষেক মৌসুমেই তাক লাগান এই স্পেনিয়ার্ড। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সময়ের তালে তালে নিজেও হয়েছেন পরিপক্ব, দল বার্সিলোনাও শিরোপা জিতেছে দুই হাত ভরে। ২০০৯-১০ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা না জিততে পারলেও টানা দুইবারের মতো লা লীগা জেতে বার্সা। তবে বছর হিসাবে ২০০৯ সালটি গার্ডিওলার জন্য ছিল সোনায় সোহাগা। এই বছরে বার্সিলোনা জিতেছিল রেকর্ড ষষ্ঠ শিরোপা, যা কোন ক্লাবের ইতিহাসে ছিল প্রথম। ২০১০ সালে শুধু লীগ শিরোপা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। তবে ২০১১ সালটি ছিল সাফল্যে ম-িত। নিজেদের রেকর্ড স্পর্শ না করতে পারলেও পাঁচটি শিরোপা আসে এই বছরের বার্সার ঘরে। আর ব্যক্তিগতভাবেও গার্ডিওলার এই বছরটি ছিল সাফল্যে ভরা। রিয়াল কোচ মরিনহো ও ম্যানইউর স্কটিশ কোচ স্যার আলেক্স ফার্গুসনকে পাশ কাটিয়ে তিনি জেতেন ফিফার বর্ষসেরা কোচের এ্যাওয়ার্ড, যা তার ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো।
বেয়ার্ন মিউনিখ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগামী ১ জুলাই থেকে কাজ শুরু করবেন ৪২ বছর বয়সী গার্ডিওলা। অনেকেই শঙ্কা করছেন, দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন করে দলকে ঢেলে সাজাবেন সাবেক বার্সা কোচ। কিন্তু বেয়ার্নের সভাপতি জানিয়েছেন, বর্তমান দল পরিবর্তন করার কোন ইচ্ছা নেই গার্ডিওলার। এদিকে গার্ডিওলার আগমন উপলক্ষে জার্মানিতে শুরু হয়েছে উৎসবের আমেজ। বুন্দেসলীগার প্রতিটি ক্লাবই খ্যাতিমান এ কোচকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। জার্মান লীগের কর্তাব্যক্তিরা আশা করছেন, গার্ডিওলা যোগ দেয়ার পর বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হবে বুন্দেসলীগা।
গার্ডিওলা নিশ্চিত হওয়ার পর অনেক কিছুর সঙ্গে একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, দায়িত্ব নেয়ার পর বেয়ার্নের আমূল পরিবর্তন করতে পারেন গার্ডিওলা। কিন্তু এমন সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দিয়েছেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট উলি হোয়েনেস। তাঁর মতে, ‘তাঁর (গার্ডিওলা) সঙ্গে আমার যেমন আলোচনা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে পারি দলের খুব একটা খেলোয়াড় পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তিনি মনে করেন না। বর্তমান স্কোয়াড নিয়েই তিনি কাজ করতে চান। তিনি এটা পছন্দ করেছেন। গত আগস্ট থেকে বেয়ার্নের খেলা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।’ ক্লাব প্রেসিডেন্ট আরও জানিয়েছেন ২০১১ সালের জুলাই মাসে প্রথম ব্যক্তিগতভাবে তিনি শুনতে পারেন বেয়ার্নে কোন এক সময় কোচিং করার আগ্রহ গার্ডিওলার। ওই সময় এ্যালিয়েঞ্জ এরিনায় একটি প্রাক মৌসুম টুর্নামেন্টে বেয়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে জয় পেয়েছিল বার্সিলোনা। হোয়েনেসের মতে, ওই ম্যাচ খেলতে এসেই গার্ডিওলা বলেছিলেন, কাজ করার স্বপ্ন আমি দেখি। আমি কখনই এখানকার অভিজ্ঞতা ভুলব না। বেয়ার্ন মিউনিখ ক্লাবের প্রেসিডেন্টের বিশ্বাস, গার্ডিওলার আগমনে জার্মান ফুটবলে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে। আগামী জুলাইয়ে শুরু হবে নয়া মিশন। এক বছরের বিশ্রাম কাটিয়ে মাঠে ফেরা গার্ডিওলা কেমন করবেন? নতুন পরিবেশ, নতুন সব শিষ্যকে নিয়ে কতটা সাফল্যের মুখ দেখবেন তিনি? নানা প্রশ্ন আর কৌতূহল শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তবে ভক্ত-সমর্থকদের প্রত্যাশা বেয়ার্নেও সাফল্যের মুখ দেখবেন গার্ডিওলা।

No comments

Powered by Blogger.