রায়ের নথি থেকে-চার মাসে ২২ হাজার রাজাকার নিয়োগ করেছিল পাকিস্তান by এম বদি-উজ-জামান ও আশরাফ-উল-আলম

বাংলাদেশে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধ চালানোর পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার। আর সেই যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা দিতে বাংলাদেশে ৩৫ হাজার রাজাকার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইয়াহিয়া সরকার।
এর অংশ হিসেবে একাত্তরের জুলাই পর্যন্ত চার মাসের মধ্যে ২২ হাজার রাজাকার নিয়োগ করা হয়।
গত সোমবার ফরিদপুরের বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ওই দিন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
রায়ে রাজাকার নিয়োগ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনাল এ কথা উল্লেখ করেন। রায়ে বলা হয়, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেক রাজাকারকে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে একটি করে রাইফেল দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের উল্লেখ করে রায়ে আরো বলা হয়, 'এটা প্রতিষ্ঠিত যে পাকিস্তান সরকার ওই সময়ের মধ্যে ২২ হাজার রাজাকার নিয়োগ দেয়।' আরো বলা হয়, পাকিস্তানি সেনা কমান্ডের অধীনে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের মধ্য থেকে বেশির ভাগ রাজাকার নিয়োগ দেওয়া হয়।
রায়ে আরো উল্লেখ আছে, পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি গঠন করে। আর এসব বাহিনী গঠনে জামায়াতে ইসলামী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান রক্ষার নামে তারা সশস্ত্র সহযোগী বাহিনী গঠন করে নিরস্ত্র বাঙালি, হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ করে। যখন গোটা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা স্বাধীনতাযুদ্ধ সমর্থন করছিল ও অংশ নিচ্ছিল, সে সময় কিছুসংখ্যক বাঙালি, বিহারি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও তার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ এর বিরোধিতা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে এসব বাহিনীতে যোগ দেয়। এ কারণেই মাত্র ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছে, প্রায় চার লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এক কোটি মানুষ দেশান্তরিত হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়।
এ মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণে এটাই প্রতিষ্ঠিত যে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করলে আবুল কালাম আযাদ তাদের স্বাগত জানান। তিনি পাকিস্তানিদের সহায়তায় অনেককে হত্যা করেন। পাকিস্তানিদের হাতে অনেককে নির্যাতনের জন্য তুলে দেন। তিনি তখন জামায়াতের রুকন ছিলেন। ওই সময়ে তিনি ফরিদপুর ও এর আশপাশের এলাকার রাজাকার ও আলবদর বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
রায়ে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ 'অপারেশন সার্চলাইটে'র নামে পাকিস্তান সরকার বাঙালি পুলিশ, সেনাবাহিনীর অফিসারদের নিরস্ত্র করার জন্য ও নিরীহ জাতীয়তাবাদী বাঙালি রাজনীতিক, সেনা কর্মকর্তা, সেনা সদস্য, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের হত্যা শুরু করে। এ কাজে তারা স্থানীয় দালাল, তথা রাজাকার, আলবদর ও জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতা নেয়। রায়ে বলা হয়, দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য এ অপারেশন সার্চলাইট অভিযান চালানো হয়।
রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর বর্বরতা চালাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা নেয় কয়েকটি নীতির ওপর ভিত্তি করে। এর অন্যতম হলো- এক. স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের প্রতিরোধ করা; দুই. উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং অন্য যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক ছিলেন, তাঁদের সম্পৃক্ত করা; তিন. প্রতিদিন আক্রমণ করে সাধারণ জনগণকে আতঙ্কিত করে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।
রায়ে আরো বলা হয়, এসব রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী সারা দেশে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে। নারীদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় ও নিজেরা ধর্ষণ করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন করে এবং তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেও বাধ্য করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.