নিরুত্তাপ বিপিএলের যাত্রা শুরু অব্যবস্থাপনায়! by মোঃ এনামুল হাসান

গতবার বিপিএলের প্রথম আসর শেষে শ্রীলঙ্কান গ্রেট মুত্তিয়া মুরলিধরন বলেছিলেন, নিঃসন্দেহে ভারতীয় আইপিএলের পর বাংলাদেশের আসরটিই বর্তমান টি২০ প্রতিযোগিতার সেরা আয়োজন।
একজন লিজেন্ডের মুখ থেকে এমন প্রশংসা গোটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই ছিল দারুণ গর্বের ব্যাপার। অথচ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বদলে গেল দৃশ্যপট। কোথায় উন্নতি হবে, বরং ব্যবস্থাপনার বিচারে এ বছর দ্বিতীয় আসরে যেন খানিক পিছিয়ে পড়েছে বিপিএল! সবচেয়ে বড় অব্যবস্থাপনাটা হয়েছে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের পাওয়া-না-পাওয়ার নাটক নিয়ে। কোটি টাকার এত বড় আয়োজন, পাক ক্রিকেটাররা খেলছেন নাÑ তা নিশ্চিত হতে আসর শুরুর আগেরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ক্রিকেটপ্রেমীদের। তাহলে বছরজুড়ে কি করল আয়োজক কমিটি! কেনইবা পাকিস্তান সফরের সঙ্গে খেলোয়াড় প্রাপ্তির বিষয়টিকে জড়িয়ে ফেলা হলোÑ এসবের কোন সদুত্তর নেই বিপিএল কর্তাব্যক্তিদের। তার সঙ্গে শেষদিকে যোগ হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদেশী বিনোদন তারকাদের বিলম্বিত উপস্থিতি, টিকেটের চড়ামূল্যে খাঁখাঁ গ্যালারি হতাশা বাড়িয়েছে আরও একধাপ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয় গত বৃহস্পতিবার অথচ তার একদিন আগে অর্থাৎ মঙ্গলবার রাতে পর্যন্তও পাকিস্তানী ক্রিকেটোরদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ। এ থেকেই বোঝা যায় বাইরে ঠাট দেখালেও ভেতরে কতটা অগোছালো অবস্থায় ছিল আয়োজক কমিটি। শেষ পর্যন্ত খেলা মাঠে গড়ানোর আগেরদিন পাকিস্তানীদের না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। আঙ্গুর ফল টকের মতো কমিটি থেকে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, আমাদের দেশের ক্রিকেটাররাই আশা করি বিপিএলের যে জৌলুস তা ধরে রাখতে পারবেন। সেই মানের ক্রিকেটার আমাদের দেশে আছেন। পিসিবি আসলে যা করেছে তা ঠিক হয়নি। আমরা টেস্ট খেলুড়ে দেশ। এমন করাটা একেবারে উচিত হয়নি। আশা করছি শেষপর্যন্ত পাকিস্তানী ক্রিকেটাররা না খেললে আমাদের দেশের ক্রিকেটাররা জৌলুস ধরে রেখে এর উচিত জবাব দিবেন। পাকিস্তান চায় নিশ্চয়তা। এখন কিভাবে নিশ্চয়তা দিবে বিসিবি। নিরাপত্তা ইস্যুটি যেনতেন ইস্যু নয়। তারা চাচ্ছে আমাদের ঠেকিয়ে সিদ্ধান্ত বের করতে। আমরা পাকিস্তানের কাছে মাথানত করতে রাজি নই।
অবশ্য অনেক আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল পাকিস্তান ক্রিকেটাররা বিপিএলে নাও খেলতে পারেন। বিপিএলের সঙ্গে পাকিস্তান সফর ইস্যুটি পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে। আর পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশ না গেলে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের বিপিএলে খেলতে দিবে না পিসিবি। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটে। তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে দলগুলোও পড়ে বিপাকে। মাত্র একদিনের মধ্যে পাকিস্তান ক্রিকেটারদের পরিবর্তে দলে টানা হয় বিদেশী অন্য ক্রিকেটারদের। এমন পরিস্থিতিতে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়। শেষ মুহূর্তে এসে দলগুলো যেখানে অনুশীলন করে মাঠে নামবে, সেসময় উল্টো ক্রিকেটার সঙ্কটে ভুগতে শুরু করে দলগুলো। এ তো গেল পাক ক্রিকেটারদের প্রাপ্তি নিয়ে নাটক। আরও বড় ব্যবস্থাপনাহীনতার পরিচয় মেলে টিকেটের চড়ামূল্যে। ছুটির দিনে সত্ত্বেও উদ্বোধনী দিনেও দর্শকহীনতায় হাহাকার করে মিরপুরের গ্যালারি! গ্যালারি দেখে মনে হয়েছে প্রথম বিভাগের কোন খেলা চলছে। গ্যালারিতে দর্শক শূন্যতার পেছনে মূলত টিকেটমূল্য। বিপিএলের খেলা সরাসরি গ্যালারিতে বসে দেখতে হলে সর্বনিম্ন ৩৫০ টাকা খরচা করতে হবে ক্রিকেটপ্রেমীদের। আন্তর্জাতিক কোন আসর না হলেও বিপিএলের জন্য টিকেটের এত চড়ামূল্য দেখেই স্টেডিয়াম বিমুখ হয়েছেন দর্শকরা। তবে এটা নিয়ে শুরুতে অতটা মাথা ঘামায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কিংবা বিপিএল গবর্নিং কাউন্সিল। বিপিএল গবর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ডা. ইসমাইল হায়দার মল্লিক জানিয়েছিলেন, আমরা একটিভ সার্ভিসেসের সঙ্গে চুক্তি করেছি এবং টাকাও পেয়েছি এখন এ বিষয়টি নিয়ে গেম অন স্পোর্টস ও একটিভ সবকিছু বুঝবে। তবে বিপিএল গবর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আফজালুর রহমান সিনহার মতে, একটিভ সার্ভিসেসকে টিকেটমূল্য কমানোর কথা বললে তারা চুক্তির টাকাও কমিয়ে দেয়ার দাবি করে যাচ্ছে। তবে তিনি জানিয়েছেন খুলনা ও চট্টগ্রামে খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ বিষয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ নেয়া হবে। দায়িত্ব নেয়ার পর টিকেট বিক্রি নিয়ে নানাবিধ উল্টোপাল্টা তথ্য জানিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো একটিভ সার্ভিসেস সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে গণমাধ্যমের সঙ্গে। টিকেট বিক্রি শুরুর দিন থেকেই তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।
প্রথম আসরে সিহাব ট্রেডিং বিপিএল টিকেট স্বত্ব কেনার পর চড়ামূল্য ধার্য করেছিল এবং ব্যবস্থা রেখেছিল এক টিকেটে দুটি খেলা দেখার। সেই সঙ্গে চিয়ারলিডার্সদের অঙ্গ সঞ্চালনা, দলের সঙ্গে থাকা মডেলকন্যাদের সরব উপস্থিতি ইত্যাদি নানা ভেল্কি দেখানোর মুলা ঝুলিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল তারা প্রত্যাশিত পরিমাণে দর্শক টানতে। এর কারণ টিকেট মূল্য। অনেক পরে নিজেদের ভুল শুধরে দুই ধাপে টিকেট মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল সিহাব ট্রেডিং। এবার আরেকটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান একটিভ সার্ভিসেস ২০ কোটি টাকার বিনিময়ে টিকেট স্বত্ব কিনে নেয়ার পর ওই টাকা উসুল করতে একেবারে অগ্নিমূল্য ধার্য করে দেয় টিকেটের। এবার বাড়তি কোন আকর্ষণীয় কিছু নেই। ফলাফল আসরের দ্বিতীয় দিনেও দর্শকহীন গ্যালারি। প্রথম আসরে সিহাব ট্রেডিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া দূরে থাক, টিকেট বিক্রি শুরুর নির্দিষ্ট সময় দিয়েও তা করতে পারেনি একটিভ। উল্টো প্রথমে তারা প্রাইম ব্যাংক, এরপর প্রিমিয়ার ব্যাংকের কথা বলেছে টিকেট বিক্রির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্যাংক দুটোয় টিকেট বিক্রি হয়নি। শেষ পর্যন্ত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (ইউসিবি) টিকেট বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেও সেটা গণমাধ্যমকে সেভাবে জানানো হয়নি বলে অনেক ক্রিকেটপ্রেমীই জানেন না কোথায় পাওয়া যাচ্ছে টিকেট। এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি একটিভ সার্ভিসেসের কাউকে। দর্শকদের খেলা দেখার আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলেও বিপিএল গবর্নি কাউন্সিল এ বিষয়ে কিছু করার নেই দাবি করেছে। আফজাল সিনহা বলেন, ‘আমরা বার বারই তাঁদের টিকেটের দাম কমাতে বলেছি। এমনকি শুক্রবার রাতেও তাঁদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। তাঁরা জানিয়েছে ২০ কোটি টাকা তো আমাদের তুলতে হবে। আমরাও চাপ দিতে পারিনি। কারণ চুক্তির পর সমস্ত দায়িত্ব গেম অন এবং একটিভের। তাছাড়া তাঁরা বলছেন, প্রথমবার এ দায়িত্ব নেয়ার কারণে বুঝে উঠতেও পারেননি।’
কিন্তু পাক ক্রিকেটারদের ছাড়াই বিপিএল আসর যথেষ্ট জৌলুস ছড়াবে এমন চ্যালেঞ্জ নেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল বিসিবি। কিন্তু বাস্তবে নতুন বিপিএল গবর্নিং কাউন্সিল এখন পর্যন্ত তার কোনটিই দেখাতে পারেনি। তাহলে কি বিপিএল সফল করার চ্যালেঞ্জ থেকে সরে এসেছে বিসিবি। এ বিষয়ে আফজাল সিনহা বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ তো আমরা নিয়েছিই। এজন্যই টিকেটের মূল্য কমাতে বলেছি। কিন্তু তারা উল্টো আমাদের চুক্তির টাকা কমাতে বলে। আমরা সভাপতি এলে খুলনা এবং চট্টগ্রামে বাকি ম্যাচগুলো দেখার পর এ বিষয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’ তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে, খুলনা পর্বের আগে টিকেটের দাম কিছুটা কমানো হয়। তাতে সাফল্য কতটা আসবে, সময়ই তার জবাব দেবে।

No comments

Powered by Blogger.