মিশ্র ক্রিকেট, মিশ্র প্রতিক্রিয়া সারাহ্্র

বিশ্বের জনপ্রিয় ক্রীড়াগুলোর মধ্যে টেনিস, ব্যাডমিন্টন কিংবা ফিগার স্কেটিংয়ে পুরুষ-মহিলার মিশ্র ইভেন্ট রয়েছে। সম্প্রতিই আধুনিক বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটেও এর প্রচলন ঘটার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
ইংল্যান্ড মহিলা ক্রিকেট দলের উইকেটরক্ষক সারাহ্্ টেইলর ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব সাসেক্সের (পুরুষ দল) দ্বিতীয় দলের হয়ে আগামী মৌসুমে কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারেনÑএমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। এটাকে ক্রিকেট উন্নয়নের দারুণ পদক্ষেপ বলে অনেক ক্রিকেটবোদ্ধাই প্রশংসা করেছেন। কিন্তু নারী-পুরুষের মিশ্র ক্রিকেট যদি ক্রিকেটের উন্নয়ন, উৎকর্ষের একটি ভাল পদক্ষেপ হয়েই থাকে সেক্ষেত্রে কেন ১৯৭০ সাল থেকে উইমেন্স ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউসিএ) পুরুষদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার ওপর একটি নিষেধাজ্ঞার ধারা রেখেছে, এটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ করছে অনেককেই। ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছে ১৯৯৮ সাল থেকে। এরপরও ওই ধারাটি বাদ যায়নি ডব্লিউসিএ’র গঠণতন্ত্র থেকে।
১৯২৬ সালে ডব্লিউসিএ গঠিত হয়। কিন্তু পুরুষদের বিরুদ্ধে কোন ক্রিকেট ম্যাচ হয়নি নারীদের। আর ১৯৭০ সালে গঠনতন্ত্রেই এ ধরনের কোন অফিসিয়াল ম্যাচের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ডব্লিউসিএ’র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন মারজোরি পোলার্ড ১৯৩৪ সালে ‘ক্রিকেট ফর উইমেন এ্যান্ড গার্লস’ নামের একটি বই লিখেছিলেন। আর সেখানেই তিনি তিনটি বড় ধরনের পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন এবং ওই তিনটি পয়েন্টে বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন নারী-পুরুষের মিশ্র ক্রিকেট আয়োজন সম্ভব নয়। পোলার্ড ওই তিনটি বিষয় বর্ণনা করে দেখিয়েছেন পুরুষদের বিরুদ্ধে নারীদের ক্রিকেট বাজে প্রভাব ফেলবে এবং এখন পর্যন্ত তাঁর সেই যুক্তিগুলো অখ-নীয়।
প্রথমত, মারজোরি পোলার্ড মনে করেন নারী ক্রিকেটের পুরোধাদের অবশ্যই নিজেদের খেলার স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেন কোন নারী ক্রিকেটার লারউডের মতো দ্রুত বল ছুড়তে এবং নারী কোন ক্রিকেটার কনস্টান্টাইনের মতো বড় শটও খেলতে সক্ষম হবেন না। এক্ষেত্রে পোলার্ড লিখেছেন, ‘নারীদের জন্য ব্যাটিংয়ের ধরনটাই আলাদা। ড্রাইভ কিংবা পুল খেলার জন্য যে শক্তিমত্তার প্রয়োজন সেটা অধিকাংশ নারীর মধ্যেই অনুপস্থিত। বোলিংয়েও পার্থক্য আছে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে বর্তমানের চেয়েও নারী বোলারদের গতি অনেক কম ছিল। আর এক্ষেত্রে বল ঠিক জায়গায় ফেলার দক্ষতাও অর্জন জরুরী।’ পোলার্ডের এ ভাষ্য বর্তমান সময়েও সত্য। মহিলা ক্রিকেটের চরম ভক্তও চোখ বন্ধ করে স্বীকার করবে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের ক্রিকেট থেকে নারী ক্রিকেট আলাদা। তবে এখানে উল্লেখ্য, বিষয় হচ্ছে কোনভাবেই পুরুষদের ক্রিকেটের তুলনায় নারী ক্রিকেট বাজে ধরনের এমনকিছু বলেননি পোলার্ড। তিনি শুধু ব্যাখ্যা করেছেন আক্রমণ, প্রতিক্রিয়া এবং কৌশলগত বিষয়গুলোতে ব্যক্তি মনোভাব। মারজোরি পোলার্ডের দ্বিতীয় পয়েন্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ যাতে মহিলা ক্রিকেটকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে এজন্য নারীদের অবশ্যই অর্থপূর্ণ মনোভাব দিয়েই খেলতে হবে। ১৯২৬ সালে ডব্লিউসিএ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গণমাধ্যমগুলোর হাস্যরসের উপকরণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে নারী ক্রিকেট। বিভিন্ন রচনা, অনুচ্ছেদ এবং জাতীয় পত্রিকাগুলোয় নারী ক্রিকেট সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘একটি কৌতুক’ ও ‘একটি ভ্রষ্টাচার’ বলে সম্বোধন করেও। বর্তমানে কিছু কিছু মিশ্র ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা এ ধরনের মন্তব্যগুলোকে আবারও ফিরিয়ে এনেছে। যেমন নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষদের ক্রিকেটে পুরুষ দলের ক্রিকেটাররা ঝাড়–র হাতল দিয়ে ব্যাট চালিয়েছেন অথবা একটি হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রেখে ব্যাটিং করেছেন। এ কারণেই পোলার্ড এবং ডব্লিউসিএ মনেপ্রাণেই চেয়ে যাচ্ছে পুরুষদের সামনে নারীদের এমন অবজ্ঞাসূচক কিছু যেদিন না থাকবে সেদিনই এ ধরনের মিশ্র ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হোক। এ বিষয়ে পোলার্ড লিখেছেন, ‘নারী ক্রিকেট সংবাদমাধ্যমে খুব কম সময়ই বড় কোন মর্যাদার স্থান পেয়েছে। তবে আমি বলতে চাই নারীরা কখনই পুরুষদের মতো ক্রিকেট খেলতে সক্ষম হবে না। পুরুষরা কেন বুঝতে চায় না আমরা তাদের মতো করে ক্রিকেট খেলতে চাই না।’ পোলার্ডের এ বিশ্লেষণ বর্তমান সময়েও গণমাধ্যমের আবহাওয়াতে বিরাজমান। হয়তো যখন সারাহ্্ টেইলর উইকেটের পেছনে থাকবেন সেক্ষেত্রে পুরুষ বোলাররা নিজে থেকেই বল একটু ধীরে ছুড়তে চাইবেন। টেলর কিভাবে এমন দ্রুতময় পেসারদের গতির সঙ্গে মানিয়ে উঠবেন? আর যদি টেলর আঘাত পান সেক্ষেত্রেইবা কি ঘটবে? ১৯৭৪-৭৫ সালে ডেনিস লিলি আর শেন থমসনদের বল মোকাবেলা করতে কিংবা তাঁদের বল উইকেটের পেছন থেকে ধরার ক্ষেত্রে একটা ভীতি কাজ করত সব ক্রিকেটারের মধ্যেই। তাই হঠাৎ করেই পুরুষদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে নামলে একই পরিস্থিতি ঘটবে টেইলরের। মারজোরি পোলার্ড তৃতীয় পয়েন্টে আলোচনা করেছেন ডব্লিউসিএ গবর্নিং বডির অবস্থান নিয়ে। এখনও ডব্লিউসিএ’র অবস্থান হচ্ছে, ‘আমরা কাউকে অনুসরণ করতে চাই না। আমরা আমাদের নিজস্ব পথে এগোতে চাই এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালাতে চাই। সুতরাং আমরা অবশ্যই নিজস্ব পন্থা মোতাবেক খেলে যাব।’

No comments

Powered by Blogger.