রাজশাহীতে একুশের প্রথম শহীদ মিনার by ড. হাসান রাজা

ভাষা বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে মানব জাতির আত্মপরিচয়ের স্মারক। মনের ভাব প্রকাশস্বরূপ সৃষ্টি ও স্রষ্টার নিরন্তর মেলবন্ধনে এ বিশ্বচরাচর নির্মিত। অভূতপূর্ব নান্দনিক বৈভবে সৃজনশীলতায় চিরবর্ধিষ্ণু সৃষ্টির বিকাশ বিজ্ঞানে ভাষা মানুষের অস্তিত্ব বিনির্মাণের প্রথম হাতিয়ার।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে অন্ধকার পহাড়ের গুহায় ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমে মানুষের পূর্বপুরুষেরা ভাষা নির্মাণের শুভ সূচনা করেছিল। মানুষের সুদীর্ঘ অধ্যবসায় আর সাধনার ফসল আজকের পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার লেখ্যরূপ। ন্যুনতম চার হাজার বছরের আবহমান বাঙালী জীবনে মাতৃভাষার অবদান অনস্বীকার্য। মাতৃভাষার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা আর হৃদ্য বাংলার মানুষকে বিশ্বদরবারে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। মাতৃভাষার জন্য এই বাঙালীরা ছাড়া বিশ্বের আর কোন জাতিকে আত্মবিসর্জন দিতে হয়নি। অনেক দিন আগে থেকেই তাই এদেশের লোক কবিরা তাঁর মাতৃভাষার মাধ্যমে মানবজীবনের সর্বোচ্চ মানবিক বিশ্বজয়ী স্লোগানে বিশ্বদরবার মুখরিত করেছেন। তাঁরা ঘোষণা করেছেন- শোন হো মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, বিশ্ব মানব হবি যদি শাশ্বত বাঙালি 'হ, গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান।
শতাব্দী লাঞ্ছিত বাংলার মানুষকে আজন্ম লড়াই-সংগ্রাম করে বেঁেচে থাকতে হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদেশী বেনিয়া লুটেরাদের শাসন-শোষণের সর্বশেষ আঘাত নেমে আসে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকে পঁূজি করে দেশ বিভাগের পর। একদিকে ভারত ও অন্যদিকে পাকিস্তান তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। তৎকালীন সময়ে এদেশের অনেক নেতৃত্বই এই বিভক্তিকে মনে-প্রাণে মেনে নেয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা হাজারো বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর ছয় মাস বারো দিন পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের পুঞ্জীভূত ােভ আর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদ অধিবেশনে ঊজিরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন ঊর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই ঘোষণার বিরোধিতা করে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাৎণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত স্কুল-কলেজে হরতাল ডাকে। ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহী কলেজের ছাত্ররাও এই হরতাল সফল করতে মাঠে নামে। রাজশাহীতে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ সুলতান, গোলাম রহমান, গোলাম তৈয়ব, তোফাজ্জ্বল হোসেন প্রমুখ। ছাত্রদের মধ্যে অংশ নেন মোঃ হারুন-অর-রশিদ, কাশেম চৌধুরী, কসিমুদ্দিন আহমেদ, নূরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান শেলী প্রমুখ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাজশাহীতে ভাষা দিবস উপল ে'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবিতে একটি মিছিল বের হলে অতর্কিতভাবে কিছু লোক মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে আহত হন ছাত্র ফেডারেশন নেতা আবদুল লতিফ, ব্রতিশ ঘোষ, ফজলুর রহমানসহ আরও অনেকে। ওই সময় সারা বাংলাদেশের অন্য কোথাও রক্ত না ঝরলেও ভাষার দাবিতে রাজশাহীর মাটিতেই প্রথম রক্ত ঝরে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারার প্রতিবাদে এদেশের ছাত্রসমাজ সফল হরতাল পালনের মাধ্যমে প্রত্যাশা করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বোধোদয় হবে এবং তাদের গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ ঘটবে। কিন্তু তা আর ঘটতে দেখা যায়নি। এর মাত্র নয় দিন পর ১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ সকলকে হতবাক করে দিয়ে ঘোষণা করেন 'উদু এবং উদর্ুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।'

No comments

Powered by Blogger.