রাজশাহী কলেজ হোস্টেল গেটে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার- সময়কাল : ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১৯৫২- সৌজন্যে : এডভোকেট মহসীন প্রামাণিক।
এই ঘোষণা সারা পূর্ব পাকিস্তানের আপামর ছাত্র-জনতাকে প্রবলভাবে প্তি করে তোলে। এর সক্রিয় প্রতিবাদস্বরূপ সারাদেশে ছাত্র-জনতার মিছিল এবং হরতাল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়।
এরই পথ ধরে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসে ছাত্র-জনতা। এই মিছিলের উপর তৎকালীন শাসক পাকিস্তানী সামরিক জান্তার আজ্ঞাবাহী পুলিশ বাহিনী নৃশংসভাবে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। সামরিক জান্তার বুলেটে মাতৃভাষার দাবিতে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম আত্মাহুতি দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও সফিউরসহ আরও অনেকে। সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। হতভম্ব হয়ে পড়ে দেশের ছাত্র-জনতা-আপামর জন সাধারণ। রাষ্ট্রভাষার দাবির মিছিলে গুলি করে ছাত্র হত্যা ! মানুষের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। দারুণ বিােভে ফেটে পড়ে দেশবাসী। সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সারাদেশের মতো রাজশাহীর ছাত্রদের রক্তেও আগুন জ্বলে ওঠে। সেদিন রাতেই রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলে আহূত ছাত্রসভায় এ ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গঠিত হয় 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।'এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন রাজশাহী মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্রনেতা এস.এম.এ. গাফফার। এ আন্দালনে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এগিয়ে আসেন মোহসেনা বেগম, সফিউর রহমান, রাজশাহী কলেজের হাবিবুর রহমান, মহসীন প্রামাণিক, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, লুত্ফর রহমান মলি্লক, আবু সাইদ, আবুল কালাম চৌধুরী, সাইদ উদ্দীন আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, আবুল হোসেন, মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি, গোলাম আরিফ টিপু প্রমুখ। স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সহযোগিতায় ছিলেন ক্যাপ্টেন শামসুল হক, এম.এল.এ. মাদার বখ্শ ও মিঞা মজিবর রহমান।
ভাষাসৈনিক সাংবাদিক সাইদ উদ্দীন আহমদ বলেন- ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রাতেই আমরা কিছু কিছু ছাত্র রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলের বিশাল প্রাঙ্গণে ইট আর কাদা দিয়ে দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেছিলাম। পরদিন বিকালে একদল পুলিশ এসে শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দিয়ে গেল। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি চালানোর পর পরই সেখানে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ফলে সেদিন ঢাকাতে শহীদ মিনার নির্মাণের মতো কোন পরিবেশ ছিল না। দেশের প্রথম নির্মিত সেই শহীদ মিনারের ছবিটি আজও রতি আছে রাজশাহীর সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ভাষাসৈনিক মহসীন প্রামাণিকের কাছে। ২২ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে সারাদেশে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে সত্য_ দেশের প্রথম একুশের শহীদ মিনারটি বর্তমানে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের প্রধান গেটের পশ্চিম পাশে স্থাপিত। যদিও এখনও দেশের প্রথম একুশের শহীদ মিনার হিসাবে এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। ২০০৯ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বেশ কয়েকজন ভাষাসৈনিকের উপস্থিতিতে সেখানে একটি ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। ইতোমধ্যে রাজশাহী কলেজ কর্তৃপ এই শহীদ মিনারটি সংরণের উদ্যোগও গ্রহণ করেছেন। এখন দেশের প্রথম একুশের শহীদ মিনারটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন।
একুশ বাঙালীর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার। একুশ আমাদের আবহমান সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সকল সৌন্দর্যের মূল ভিত্তি। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসাবে আমরা আমাদের জীবনঘনিষ্ঠ চেতনার সঙ্গে সবচেয়ে গভীর অন্তরঙ্গ ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করি একুশের সঙ্গে।
বাঙালীর হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন যে মুক্তিযুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, একটি লাল সবুজ পতাকা, সে মুক্তিযুদ্ধ যুক্তির দিক থেকে, বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে, আবেগের দিক থেকে মুখ্যত ভাষা আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি।
২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী আজকের এই দিনে তাদের মায়ের ভাষাকে সম্মান জানানোর মহিমান্বিত গৌরবে অভিষিক্ত হবে বাংলা ভাষার অভূতপূর্ব বিশ্বনন্দিত ইতিহাসকে সামনে রেখে।
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত পথ বেয়ে এসেছিল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। এক সাগর রক্ত পেরিয়ে, দুই ল মা-বোনের পবিত্র সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের মহান স্বাধীনতা।
তাই, একুশ বাঙালীর আত্মপরিচয়।
একুশ বাঙালীর প্রথম চৈতন্য।
একুশ বাঙালীর অন্ধকার আকাশের প্রথম আলোকিত সূর্য,
যে সূর্য আজ আমাদের জাতীয় পতাকা।
একুশের ঐতিহাসিক প্রথম শহীদ মিনারের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন হোক। সেই সাথে বাঙালী চেতনার অভূতপূর্ব অবিসংবাদিত আত্মমর্যাদার লড়াই মহান ভাষা আন্দালনে শাহাদত বরণকারী সকল বীর শহীদের প্রতি নতশিরে প্রণতি জানাই।
লেখক : কবি, লেখক ও গবেষক
রাজশাহী।
ঋ-বটধফ:দট্র্রটভরটনটঞরটনআহটদমম.ডমব.
No comments