জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার অভিলাষ রাফির by রুমেল খান

এই ক্রীড়াভুবনের ক্রীড়ামঞ্চে অসংখ্য ক্রীড়ার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কোন্টি? সবাই এক কথায় জবাব দেবেন ফুটবল। এ খেলার অনুরাগীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে তাঁদের ওপরÑ যাঁরা গোল করেন।
কিন্তু গোলরক্ষক যদি বিপক্ষের আক্রমণকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে দল হারবে। কাজেই স্ট্রাইকার-মিডফিল্ডার-ডিফেন্ডারদের চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নন একজন গোলরক্ষক। গোলপোস্টের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে যুগে যুগে খ্যাতিমান হয়েছেন লেভ ইয়াসিন, গর্ডন ব্যাঙ্কস, পিটার শিলটন, দিনো জফ, সেপ মেয়ার, অলিভার কান, পিটার স্মাইকেল, পিটার চেক, জোসে লুই চিলাভার্ট, রেনে হিগুইতা, ওয়াল্টার জেঙ্গা, ফাবিয়ান বার্থেজ, ভ্যান ডার সার, জিয়াইনলুজি বুফন, ইকার ক্যাসিয়াস, সার্জেই গয়কোচিয়া, হ্যারল্ড শুমাখার, রিনাত দাসায়েভ ও প্যাট্রিক জেনিংস। বাংলাদেশের বিখ্যাত গোলরক্ষকের মধ্যে আছেন সান্টু, কানন, মোহসীন, আমিনুল, বিপ্লবরা। একদিন এদের কাতারে অধিষ্ঠিত হতে চান তরুণ সম্ভাবনাময় গোলরক্ষক রাফি রহমান, যিনি চলতি মৌসুমে খেলছেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লীগে টানা ছয় ম্যাচে হেরে রেলিগেশনের আতঙ্কে কাঁপছিল গোপীবাগের ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়ন। ক্লাবটির ইতিহাসে এমনটা কখনও ঘটেনি। ১২ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত নিজেদের সপ্তম ম্যাচে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘকে ২-০ গোলে হারিয়ে সে ভয় কিছুটা হলেও দূর করে স্বস্তির নিশ্বাস নেয় দলটি। খেলা শেষে কথা হয় ব্রাদার্সের অতিরিক্ত গোলরক্ষক রাফি রহমানের সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে একটি মজার তথ্য জানালেন তিনি, ‘যে আরামবাগকে আজ আমরা হারালাম (ম্যাচে অবশ্য রাফি খেলেননি), ওই দলেরই হয়ে সর্বশেষ মৌসুমে আমি খেলেছিলাম!’
ছয় বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে সৌভাগ্যবশত এখনও কোন ইনজুরিতে না পড়া রাফি বলেন, ‘সমসাময়িক সতীর্থ গোলরক্ষক লিটনকে খুবই সম্ভাবনাময় মনে হয়।’ বছরে বারো মাস মাঠে ফুটবল খেলা থাকার জন্য বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিনকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন রাফি, ‘তাঁর কারণেই আমরা এখন ফুটবল খেলে অর্থ উপার্জন করতে পারছি। তাঁর ভিশন ২০২২ ফর্মুলা মোতাবেক আমরা চাই বাংলাদেশ সে সময় কাতার বিশ্বকাপে যেন খেলতে পারে এবং আমিও যেন ওই দলে থাকি।’ আজ থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে রাফি নিজেকে দেখতে চান মূল জাতীয় দলের নিয়মিত একাদশের খেলোয়াড় এবং গোলরক্ষক হিসেবে। ‘আমার স্বপ্ন হচ্ছে একদিন জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়া। এ জন্য এখন থেকেই নিজেকে কঠোর অনুশীলনের মধ্যে তৈরি করছি।’ ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলাটা ভাল লাগত রাফির। সেটা আরও গাঢ় হয় ২০০৬ বিশ্বকাপ দেখার পর। তার আদর্শ গোলরক্ষক ইতালির জিয়ানলুইজি বুফন। দেশে প্রিয় বিপ্লব ভট্টাচার্য, আমিনুল হক এবং সোহেল ভাইয়ের গোলকীপিং। তাঁরা মাঝে মাঝে রাফিকে উৎসাহও দেন।
২০০৭ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন রাফি। মজার ব্যাপার, প্রথমে তিনি ছিলেন স্ট্রাইকার! মুস্তাক ভাইয়ের পরামর্শে (শেখ জামালের গোলরক্ষক) গোলরক্ষক হন।
৫ ফুট ৮ ইঞ্চির রাফির ভাষ্য, ‘গোলকীপার হতে গেলে লম্বা হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। ইচ্ছা এবং টেকনিকই হচ্ছে আসল ব্যাপার। বুফনও তেমন লম্বা নন। তারপরও তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলকীপার।’ নিজ পরিবার বরবারই রাফিকে ফুটবল খেলতে উৎসাহ যুগিয়েছে, ‘সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেন মামুন এবং রুবেল ভাই।’ কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে ১৯৯২ সালের ৩ জুন জন্ম নেয়া রাফি স্থানীয় স্কুলে এক বছর পড়ার পর ভর্তি হন ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে। এরপর ভর্তি হন বিকেএসপিতে। এখন তিনি ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থী।
বিকেএসপিতে পড়ার সময়ই প্রথম কোন প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলেন। ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সুব্রত কাপে (অনুর্ধ-১৪) বাংলাদেশের হয়ে রানার্সআপ হন, ‘ফাইনালে নেপালের কাছে হারি ১-০ গোলে। কোচ ছিলেন উজ্জ্বল চক্রবর্তী।’ এরপর ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জাতীয় অনুর্ধ-১৪, ১৬ ও ১৯ দলে খেলেন। পেশাদার লীগে খেলার সুযোগ পান ২০১০ সালেই। প্রথম ক্লাব ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং। পরের মৌসুমে দলবদলের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরামবাগ ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য অফার করলে সেটা গ্রহণ করেন। এরপর বাফুফে দুটি দল গঠন করে ৮১ ফুটবলারকে নিয়ে। রাফি সুযোগ পান বাংলাদেশ সাদা দলের হয়ে খেলার। এরপর ব্রাদার্সের ম্যানেজার আমের খান তাঁকে পছন্দ করেন। রাফি সই করেন ব্রাদার্সের হয়ে খেলার জন্য।
তবে চলমান লীগে এখনও পর্যন্ত কোন ম্যাচ খেলতে পারেননি রাফি, ‘এজন্য কিছুটা হতাশ। হয়ত কোচ আমাকে এখনও খেলানোর উপযোগী মনে করেননি। তবে আমি খেলার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত আছি।’ আগে গ্রামে থাকলেও এখন ঢাকার বনানীতে বাস করা রাফি শোনালেন স্মরণীয় ম্যাচের গল্প, ‘২০০৯ সালে অনুর্ধ-১৬ দলের হয়ে খেলতে গেছি ফিলিপিনে। আমরা মাত্র সাতদিনের অনুশীলনে ওখানে গিয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে খেলা। খেলার আগে প্রেস কনফারেন্সে ইন্দোনেশিয়ার ক্যাপ্টেন বলল, তারা বাংলাদেশকে ৫ গোল দেবে। পরে ম্যাচটি ড্র হয় এবং আমি ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হই।’
মজার স্মৃতি কোন্টি? ‘২০০৯ সালেই জাপানের বিরুদ্ধে আমরা ০-৬ গোলে হারি। কিন্তু ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার পাই আমি!’
‘তরুণ প্রজন্মের কেউ যদি ফুটবলার হতে চায়, তাদের প্রতি রাফির বক্তব্য, ‘পরামর্শ দেব ডিসিপ্লিন মেইনটেন করা, ফিটনেস ধরে রাখা এবং মাদক থেকে দূরে থাকাÑ এগুলো মেনে চলতে।’ অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া রাফিরা তিন ভাই, এক বোন। তিনি সবার ছোট। খেলার জন্য পড়াশোনায় তেমন বিঘœ ঘটে না। তবে পরীক্ষার সময় একটু বেশি পড়তে হয় এই আর কি!
রাফির স্বপ্ন কতটা পূরণ হয়, সেটা বলে দেবে ভবিষ্যত।

No comments

Powered by Blogger.