ইচ্ছে ছিল গায়ক হওয়ার, কিন্তু... by রুমেল খান

ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে আমরা টিভিতে বা রেডিওতে বিভিন্ন খেলা দেখি বা শুনি। এই খেলা কখন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে বলুন তো? খেলার খুটিনাটি ও চলমান খেলার ধারা বিবরণীকে যখন কেউ সুন্দর কথার মাধুর্যে প্রকাশ করেন, তখনই খেলা দেখতে বা শুনতে মজা পায় সবাই।
তখন খেলোয়াড়দের পাশাপাশি একজন ধারাভাষ্যকারও হয়ে ওঠেন তারকা, আলোচিত ও বিনোদনকারী। ক্রীড়ার কথাশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশে বহু বছর ধরে যিনি স্বীয় নৈপুণ্যে সমুজ্জ্বল, তিনি হলেন চৌধুরী জাফরউলস্নাহ শারাফাত। দেশে-বিদেশে যার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অগণিত ভক্ত-অনুরাগী। তবে সমালোচকও যে নেই তা বলা যাবে না। অনেকদিন ধরেই তাঁকে নিয়ে ফিচার প্রকাশের জন্য জনকণ্ঠের বিভিন্ন পাঠকরা চিঠি লিখে ও ফোন করে আবদার জানিয়ে আসছিল। তারই পরিপ্রেৰিতে ক্রীড়া সম্পাদকের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখন এসএ গেমসে তিনি ব্যসত্ম ফুটবলের ধারাভাষ্য নিয়ে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ৩১ জানুয়ারি মালদ্বীপ-ভুটান ম্যাচে যে ম্যাচটি হয়েছিল, সেদিন সে খেলা শুরম্নর অনেক আগে মাঠে গিয়ে হাজির হই। মিডিয়া সেন্টারে গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেল। বিটিভির হয়ে কমেন্ট্রি দেবেন তিনি। কুশল বিনিময় শেষে সরাসরি চলে গেলাম সাৰাতকার পর্বে। শুরম্নতেই তাঁকে প্রশ্ন করি, উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠ ও ধারাভাষ্য_ এই তিনটির মধ্যে কি পার্থক্য আছে? জবাবে উদাহরণ দিয়ে বিশেস্নষণ করলেন শারাফাত, 'অবশ্যই পার্থক্য আছে। যাঁরা সংবাদ পড়েন, তারা দেখে দেখে পড়ে, উপস্থাপকরা উপস্থাপনা করেন স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করে। আর ধারাভাষ্যকাররা এর কোনটাই করেন না। তাঁদের কথা বলতে হয় দ্রম্নত, পরিস্থিতি অনুযায়ী ও তাৎৰণিকভাবে। ফলে ভুল হবার ঝুঁকি থাকে। হয়ও। তাই এই মাধ্যমটা বাকি দুটো থেকে অনেক বেশি কঠিন।' শারাফাতকে দেখা যায় প্রধানত দু'টি খেলায় কমেন্ট্রি করতে_ ফুটবল ও ক্রিকেটে। কোন্টিতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন তিনি? 'অবশ্যই ক্রিকেটে। কেননা, এ খেলায় কথা বলার প্রচুর সময় পাওয়া যায়, গুছিয়ে, মনের মতো করে কমেন্ট্রি করা যায়। ফুটবলে যা সম্ভব নয়।' অনেকেরই প্রিয় ধারাভাষ্যকার তিনি। স্বভাবতই প্রশ্ন মনে জাগে, তাঁর প্রিয় ধারাভাষ্যকার কারা? 'সবচেয়ে প্রিয় টনি গ্রেগ। এছাড়া রবিশাস্ত্রী, হার্শা ভোগলে, রমিজ রাজা, প্রয়াত ওমর কোরেশীও আছেন। বাঙালী ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি কলকাতার প্রয়াত অজয় বসু। তাঁর কণ্ঠশৈলী ও স্টাইল আমার ভীষণ ভাল লাগে।' ধারাভাষ্য নিয়ে সবচেয়ে স্মরণীয় বা মজার কোন স্মৃতির কথায় তিনি ফিরে গেলেন ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির আসরে। ফাইনালে বাংলাদেশের ১ বলে ১ রান_ এই রোমাঞ্চকর মুহূর্ত এখনও তাঁর মানসপটে দাগ কেটে আছে। তাছাড়া শিরোপা জিতে দেশে ফিরে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে ক্রিকেট দলের সঙ্গে তাঁকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল, তা জীবনেও ভুলবেন না তিনি। ধারাভাষ্য নিয়ে তাঁকে যখন কেউ সমালোচনা করে, তখন তাঁর কেমন লাগে? 'আমি সব সময়ই সমালোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি। আমি মনে করি, কেউ যদি আমার সামনাসামনি আমার ভুল ধরিয়ে দেন, তাহলে এটা অবশ্যই সমালোচনা। তখন আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁকে আমার বন্ধু হিসেবে গণ্য করব। আর যাঁরা আমাকে আমার ভুল না ধরিয়ে নিন্দা বা অবজ্ঞার সুরে কিছু বলেন, তখন তাদের কি বলে গণ্য করা উচিত, সেটা না হয় নাই বললাম।' খেলার আগে ধারাভাষ্য দেয়ার প্রস্তুতিটা তার কেমন? 'অনেকেই ভাবেন, মাঠে গেলাম আর কমেন্টি করলাম। এটা ভুল ধারণা। প্রচুর হোমওয়ার্ক করতে হয় আমাকে। আগামীদিনের পত্রিকার খেলার পাতা পড়ি। সংগ্রহ করি নতুন তথ্য, কিভাবে কি বলব, তার জন্য রিহাসার্ল ও পস্ন্যান করি।' সফল ও জনপ্রিয় কমেন্টেটর হবার জন্য কি কি যোগ্যতা বা গুণাবলী থাকা দরকার? 'প্রথমেই সংশিস্নষ্ট খেলা সম্পর্কে টেকিনিক্যাল জ্ঞান, শুদ্ধ উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা বলার ৰমতা_ এগুলো থাকলেই যথেষ্ট।' শারাফাতের এ কথার পরিপ্রেৰিতেই যে প্রশ্নটা করা উচিত, সেটাই করলাম_ 'নিজেকে কি সফল ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হিসেবে মনে করেন?' একটু বিব্রত হয়ে উত্তরটা সরাসরি দিতে চাইলেন না তিনি, 'যখন রাসত্মা দিয়ে হেঁটে যাই, তখন আশপাশের মানুষজন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমার ধারাভাষ্য নকল করে শোনায়। কমেন্টেটর হতে চেয়ে অনেকেই টিভি বা বেতারে অডিশন দেয়। একদিনের ঘটনা, বাংলাদেশ বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আমাকে বললেন, 'আপনি এসব কি শুরম্ন করেছেন?' 'মানে? বললাম আমি।' 'অডিশনে যারাই আসে, তারাই দেখি সবাই আপনার অনুকরণে ধারাভাষ্য দিচ্ছে। এসব হচ্ছেটা কি?' 'এখন আপনারাই বুঝে নিন। তবে আমি মনে করি, এতটা না হলেও ধারাভাষ্য দিয়ে সামান্য কিছু হলেও করতে পেরেছি।' বাংলাদেশের প্রেৰাপটে ধারাভাষ্যকে পেশা হিসেবে নেয়া যায় কি? 'না, এখন পর্যনত্ম না। কারণটা সম্পূর্ণ আর্থিক। এদেশে আমরা যে ক'জন ধারাভাষ্যকার আছি, তারা সবাই চাকরিজীবী। আমার কথাই বলি। আমি একজন ব্যাংকার। এই চাকরির টাকাতেই আমাকে সংসার চালাতে হয়। ধারাভাষ্য দিয়ে যা পাই, সেটা একেবারেই অপ্রতুল। অথচ উপমহাদেশের অন্য ধারাভাষ্যকাররা এটাকে ফুলটাইম জব হিসেবে নিয়েছেন। পারিশ্রমিক পাচ্ছেন অবিশ্বাস্য অঙ্কের অর্থ।' এদেশে এই মাধ্যমটি বড়ই অবহেলিত বলে আৰেপ করলেন শারাফাত, 'ধারাভাষ্য একটা শিল্প। এখানে অনতিবিলম্বে পেশাদারিত্ব আনাটা জরম্নরী। ধারাভাষ্যের মান বাড়াতে হলে অবশ্যই 'ট্যালেন্ট হান্ট' করতে হবে। যেমনটা হয় নাচ, গান, অভিনয়ের বেলায়। এটা না করলে এদেশের কমেন্ট্রির মান বিশ্বমানের হবে, এমনটা আশা করা বোকামি।' বাংলাদেশের মহিলারা যেন ক্রীড়া ধারাভাষ্যে আসে_ এটা তিনি আনত্মরিকভাবে আশা করেন, 'ভারত, দৰিণ আফ্রিকা, উইন্ডিজের মহিলারা ধারাভাষ্যে আসছে। কেবল আমরাই পিছিয়ে। যেদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সবাই মহিলা, সেখানে তাঁরা এ পেশায় আসতেই পারেন। তাছাড়া দেশের মেয়েরা এখন সব ধরনের খেলাই খেলছেন। খেলতে পারলে ধারাভাষ্যে আসতে পারবেন না কেন?' ভবিষ্যতে ধারাভাষ্যে নিজেকে কোন্ অবস্থানে দেখতে চান? 'ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম দিককার সব জয়ের ধারাভাষ্যই আমার কণ্ঠে শুনেছে দেশবাসী। এজন্য নিজেকে খুব লাকি মনে করি। একদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবে, আর সেই বিজয়ের ধারাভাষ্য দেব আমি_ এটাই আমার স্বপ্ন।' অনেকেই জানেন কণ্ঠশিল্পী হবার শখ ছিল শারাফাতের। গাইতেনও বেশ। সেই অপূর্ণ স্বপ্নকে ধারাভাষ্য হয়ে 'দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন কিনা?' এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'এটা ঠিক, গায়ক হবার সুপ্ত বাসনা ছিল। কিন্তু রৰণশীল পরিবারের অনুশাসনে আমি ধর্মভীরম্ন হয়ে পড়াতে আর গায়ক হইনি। তখন ঠিক করি, এমন একটা পেশা বেছে নেব, যেন পারিবারিক বাধা না আসে। কেননা, সবাই কমবেশি গান গায়, কিন্তু সবাই ধারাভাষ্য পারে না। তাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে বেছে নেই ধারাভাষ্য।' 'ধারাভাষ্যের কল্যাণে এ পর্যনত্ম ক'টি পুরস্কার পেয়েছেন?' 'সেভাবে মনে রাখিনি। তবে দু'শ' পস্নাস তো হবেই।' 'এত পুরস্কারের মধ্যে সেরা কোন্টি?' 'পুরস্কার পুরস্কারই। একে শ্রেণীবিভাগ করতে চাই না। সবচেয়ে বড় পুরস্কার শ্রোতা-ভক্তদের ভালবাসা। তবে সর্বশেষ পাওয়া পুরস্কারটি পেয়ে খুব ভাল লেগেছে। জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর শ্রেষ্ঠ বাঙালী ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে 'আমেরিকা বেঙ্গলি ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস এ্যাওয়ার্ড' গ্রহণ করি বাংলাদেশ থেকে আগত ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ক্রীড়ামন্ত্রী আহাদ আলী সরকারের হাত থেকে। এছাড়া ঐ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান ও সেরা বোলারের পুরস্কার লাভ করেন মোহাম্মদ আশরাফুল ও মাশরাফি মতর্ুজা। এ পুরস্কার পেয়ে আমার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। দোয়া করবেন, যেন নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করতে পারি। আর ক্রীড়ামোদীদের আনন্দ দিতে পারি।'

No comments

Powered by Blogger.