সমকালীন প্রসঙ্গ-বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার দুর্দিন by বদরুদ্দীন উমর

শ্রেণীবিভক্ত সমাজে যারা শোষক তারা ইতিহাসের সত্য গোপন করে সত্য ঘটনাকে মিথ্যা কাহিনী দিয়ে আড়াল করে এবং এ মিথ্যা কাহিনীকে প্রতিষ্ঠার জন্য বলপ্রয়োগ পর্যন্ত করে। নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার জন্য যখনই প্রয়োজন হয় তখনই তারা এ কাজ করে থাকে।
যারা অন্য দেশ দখল করে অন্য সমাজের ওপর নিজেদের শাসন-শোষণ কায়েম রাখে তারা দখলকৃত দেশের ইতিহাস বিকৃত করে। আমরা ইতিহাসের এই বিকৃতকরণ যেমন দেখেছি, ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস চর্চায় তেমনি দেখেছি ও দেখছি সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাস চর্চায়।
বিখ্যাত জন স্টুয়ার্ট মিলের পিতা ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তিনকাল পর্বে বিভক্ত করে আখ্যায়িত করেন যথাক্রমে হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ ও ব্রিটিশ যুগ হিসেবে। আপাতদৃষ্টিতে এই আখ্যার মধ্যে আপত্তিকর কিছু চোখে না পড়লেও এটা ছিল এমন এক বিভক্তির নীতি, যার ধারাবাহিকতায় বিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মধ্য যুগের ইতিহাসকে মুসলমান যুগ বললেও আধুনিক যুগের ইতিহাসকে খ্রিস্টান যুগ না বলে জেমস মিল বললেন ব্রিটিশ যুগ। ভারতীয় ইতিহাসবিদরাও এই আখ্যাকেই শিরোধার্য করে ব্রিটিশপূর্ব ভারতের ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত করলেন। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসকে খ্রিস্টান বললেন না। পাঠ্যপুস্তকগুলো সেভাবেই লিখিত হলো। মধ্য যুগের ইতিহাসকে মুসলমান যুগ বলে আখ্যায়িত করে হিন্দুদের ওপর মুসলমান শাসকদের ধর্মীয়সহ নানা নির্যাতনের কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়ে পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেল। ব্রিটিশ শিক্ষানীতি ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে এভাবে সাম্প্রদায়িক চিন্তার যে বীজ বপন করল সেটাই পরে মহীরুহের আকার ধারণ করে সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে পত্রপল্লবে বিকশিত হলো। সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসবিদ হিসেবে জেমস মিল যা শুরু করেছিলেন তারই পরিণতি ঘটল মাউন্টব্যাটনের দ্বারা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের মধ্যে। শোষণ-শাসনের ক্ষেত্রে ইতিহাস চর্চার ভূমিকা যে অপেক্ষার বিষয় নয়, বরং অতীব গুরুত্বপূর্ণ, এটা ভারতে যত স্পষ্টভাবে দেখা যায়, এমন আর কোথাও দেখা যায় না।
পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী ১৯৪৭ সালের পর সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে ইতিহাসকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অনেক ধরনের অভ্যন্তরীণ কারণে তাদের বিশেষ সাফল্য আসেনি। এদিক দিয়ে সাফল্য কাকে বলে সেটা দেখার জন্য তাকাতে হবে বাংলাদেশের দিকে। ১৯৭১ সালের পর থেকে শাসকশ্রেণী বাংলাদেশের ইতিহাস যেভাবে বিকৃত করেছে, এই বিকৃত ইতিহাস এরা যেভাবে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে তৈরি ও ব্যবহার করেছে এটা চমৎকৃত হওয়ার মতো ব্যাপার।
বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও তাদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সাল থেকেই শিক্ষা বিষয়ক নীতিনির্ধারণের সময় নতুনভাবে তাদের তৈরি ও প্রচারিত ইতিহাসকে গ্রাহ্যতা দেওয়া ও গ্রহণযোগ্য করার পদ্ধতি হিসেবে স্কুলের পাঠ্য তালিকা থেকে ইতিহাস বিষয়কে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মধ্যে যে ধূর্ততার পরিচয় পাওয়া যায় সেটা বিস্ময়কর। এ কাজ অন্য কোনো দেশে দেখা যায়নি। অন্য দেশে শাসকশ্রেণী নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসকে ব্যবহার করলেও স্বদেশের ইতিহাস বিষয়ে নিজেদের নতুন প্রজন্ম ও সাধারণভাবে জনগণকে একেবারে অন্ধকারে রাখে না। প্রচলিত ইতিহাস পাঠ একেবারে বন্ধ করে না। কিন্তু বাংলাদেশে সেটাই করা হয়েছে। এর কারণ যা হয়েছে তাকে বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতকরণ না বলে ইতিহাসের বিলোপ সাধন বলা চলে। এই বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে পুনর্লিখিত ইতিহাসকে চালু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য প্রয়োজন হয়েছে ইতিহাস বলতে এতদিন যা পাঠ করা হয়েছে তার চর্চা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে শিক্ষার্থীদের চেতনা থেকে ইতিহাসকে মুছে ফেলা। প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সে বিষয়ে সকলকে অন্ধকারে রাখা।
এতে সুবিধা হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সামনে রাখা হয়েছে সাদা কাগজ এবং সেই সাদা কাগজে শাসকশ্রেণীর লোকেরা নিজেদের কালি-কলম দিয়ে যা ইচ্ছা লিখছে। সেটাই তারা প্রচার করছে এবং শিক্ষার্থীরা তাই পাঠ করছে। এর ফলে নিজেদের দেশের শত শত বছরের ইতিহাস থেকে সাম্প্রতিক ইতিহাস বিষয়ে তারা কিছু না জানলেও কতগুলো মিথ্যা কাহিনী ইতিহাস হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে। এই ইতিহাস কোনো সুশিক্ষিত ও দক্ষ ইতিহাসবিদ রচনা করছেন না। এটা রচিত হচ্ছে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নেতা এবং তাদের কৃপাপ্রার্থী কিছু বুদ্ধিজীবী দ্বারা। ইতিহাসবিদ না হয়েও বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে তারাই চূড়ান্ত কথা বলছেন। এই মিথ্যা ইতিহাস বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট কাহিনী ও প্রবন্ধ এবং পুস্তক আকারে লিখিত হচ্ছে এবং লোকের মুখে মুখে রাজনৈতিক প্রচারণার মতো করে প্রচারিত হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাস এখন পরিণত হয়েছে কতগুলো মিথ্যা কাহিনীতে এবং এই ইতিহাসের অভিভাবক হয়েছে শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দল। এই ইতিহাসের বিরোধিতা বাংলাদেশে এক বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ এর অভিভাবকরা এ ইতিহাসকে নানাভাবে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রক্ষা করে।
বাংলাদেশে এখন সাধারণভাবে ইতিহাস চর্চা মানে বোঝায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক আলোচনা। ইতিহাস বলতে যে এর পেছনেও কিছু আছে, হাজার বছর, শত শত বছর আছে, এটা বর্তমান প্রজন্মের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। আগে স্কুল পর্যায়ে ইতিহাস পাঠ্য বিষয় থাকার কারণে সকলকেই তা পড়তে হতো, জানতে হতো প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাস; ব্রিটেন, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস। সেই ইতিহাস হলো বাংলাদেশের শিক্ষিতদের কাছে এক অন্ধকার দেশ। এখানে ইতিহাসের সব আলো এখন ১৯৭১ সালের ওপর। ১৯৭১ সালের আগে যে আমাদের দেশের ইতিহাস আছে এবং তা পাঠ করা শুধু স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীর নয়, সাধারণভাবে শিক্ষিত লোকদেরও প্রয়োজন, এটা বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের ধারণার একেবারেই বাইরে।
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ইতিহাস বিষয়ক সব থেকে জমজমাট বিতর্ক হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেছিল এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও যুদ্ধের সময় কী ঘটেছিল তার সত্যতা নির্ধারণের দায়িত্ব এখন আর কোনো ইতিহাসবিদের নয়। এ দায়িত্ব হলো আওয়ামী লীগ, বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের অর্ধশিক্ষিত নেতা-নেত্রীদের! এমনকি তাদের অশিক্ষিত কর্মীদের!
যে জাতি নিজের ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞ, যার নিজের পরিচয় অন্ধকারে, তার থেকে হতভাগ্য জাতি আর কোথায় আছে? বাংলাদেশের বাঙালিরা হলো এমনই এক হতভাগ্য জাতি।

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.