বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসি- ইতিহাসের অমোঘ রায়
আরেকটি দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তবর্ণে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ২১ জানুয়ারি ২০১৩। এই দিনটির সাক্ষী হয়ে থাকল অগণন মানুষ। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যারা একদিন অস্ত্র হাতে ধরেছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্মম অত্যাচার সয়ে, নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণ-
লুটতরাজের শিকার হয়েও যারা একদিন অটল বিশ্বাস রেখেছিলেন স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রত্যয়ে, তাদের জন্য ২১ জানুয়ারি হয়ে থাকল স্বস্তি ও আশাবাদের একটি তারিখ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তঋণ বয়ে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিচারহীনতার যে অপরাধবোধে ভুগেছে বিগত ৪১ বছর, এটি তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। বিশ্বসভায় বাঙালি জানিয়ে দিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম বৃথা যায়নি। সেদিন যে রক্তনদী প্রবাহিত হয়েছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে, তা আজ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে বইয়ে চেতনার পতাকা উচ্চে তুলে ধরেছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মগুলো আজ স্পষ্ট জানল, বাংলাদেশ অপরাজেয়_ মুক্তিযুদ্ধ এখনও জাগাতে পারে দেশকে, সম্ভব করে তুলতে পারে এ দেশের নবজন্ম ও নবযাত্রা। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে, ন্যায়বিচারের পথ সমুন্নত করতে এ জাতিকে পাড়ি দিতে হয়েছে কষ্ট ও ক্লান্তিকর দীর্ঘ পথ। চরম বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই রাষ্রদ্বক্ষমতার অলিন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের আধিপত্য। পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চৈতন্যের যে নির্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তাতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার দূরে থাক, প্রকাশ্যে তাদের সমালোচনাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের মদদে, সমর্থনে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভূলুণ্ঠিত করায় প্রয়াসী হয়েছিল। প্রজন্মকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল এ দেশের জন্মমুহূর্তের বেদনদায়ক স্মৃতি। না, শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি তারা। ফিনিক্স পাখির মতো পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলেছে ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের দাবিয়ে রাখা ইতিহাস আবারও জেগে উঠেছে কালক্রমে। জনে জনে ছড়িয়ে পড়েছে। সে ইতিহাসের ছায়াতলে আবার আশ্রয় নিয়েছে নতুন প্রজন্ম। আর ১৯৭১ সালে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে_ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন, অগি্নসংযোগের দায় যাদের, সেই রাজাকার-আলবদরদের বিচারের দাবিও উঠেছে ধীরে ধীরে। কে ভুলে যাবে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সেই আন্দোলনের কথা! এই মহীয়সী নারী একদিন নতুন প্রজন্মকে এ সত্য জানিয়েছিলেন_ বিচারের পথ রুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সত্য ও ন্যায়কে শেষ পর্যন্ত রুখে দেওয়া যায় না। গণআদালতের প্রতীকী বিচারের মাধ্যমে তিনি যে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সে প্রত্যাশা এখন সত্যিকারের আদালতের রায়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে চলেছে। অনেক দেরি হয়েছে সত্য, কিন্তু বিচারহীনতা যে শেষ কথা নয়_ সে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দিকে জাতির শুভ প্রত্যাবর্তনের স্মারক হয়ে থাকল একাত্তরের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়। শুধু শহীদজননী নন, তারপর এ দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন বহু মানুষ। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি দীর্ঘদিন ঘাম ঝরানো আন্দোলন করেছে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নানা কর্মসূচিতে জোরদার করেছে এ দাবি। সর্বোপরি, নতুন প্রজন্ম ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে এ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারের অঙ্গীকার করেছিল। বিচার আয়োজন কঠিন ছিল। দেশীয় নানা মহলের সঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক নানা শক্তির অসন্তোষ ও চোখ রাঙানি। কিন্তু সব ম্লান করে দিয়ে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এ জন্য জাতির কৃতজ্ঞতা সরকারের প্রতি। বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই এ বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তার সময়ে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১৯৭৩ অনুসরণ করেই এবারের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুধু আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা নয়_ দলমত নির্বিশেষে কোটি মানুষের হৃদয়ের দাবি এটি। এ রায়ের ফলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়ে যাবে_ তা বলাই বাহুল্য। একই সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান খুবই অপ্রত্যাশিত। বিএনপি শুধু একটি বড় দল নয়, এ দলে রয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধাও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহ্যের কথা দলটির নেতারা গর্বভরে বলেন। তা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে দলটির বিরুদ্ধে অবস্থান এখন স্পষ্ট। তারা রায় শুনে যে মন্তব্য করেছেন, তা দুঃখজনক। অবিচার ও বিচারহীনতা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে এ বিচারের প্রতি দলটির বিরোধিতা নয়, সমর্থনই প্রত্যাশিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাতি এখন একাট্টা। কোনো বাধাই আর বাধা নয়। আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর রায়ের মধ্য দিয়ে যে বিচার শুরু হলো, একে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে নিতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সকল অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুততার সঙ্গে বিচারের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে। প্রথম রায়ে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এখন আপিল করতে পারবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে বাচ্চু রাজাকার পলাতক। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে আছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান ও পাকিস্তানি গণমাধ্যমের ভূমিকা হতাশাজনক, কিন্তু তাদের এ অবস্থান অপ্রত্যাশিত নয়। আমরা আশা করব, তিনি যেখানেই থাকুন, তাকে ইন্টারপোলের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। এ ক্ষেত্রে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরদার উদ্যোগই আমরা দেখতে চাই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাকি যাদের বিচার চলছে, তাদের রায়ের অপেক্ষায় এখন দেশবাসী। ইতিহাসের কলঙ্কমোচনের যে অধ্যায় শুরু হলো, তা পূর্ণ করতে এসব বিচার সম্পন্ন হওয়া দরকার। জাতির সেই অধীর প্রতীক্ষার অবসান ঘটুক।
No comments