স্মরণ-হঠাৎ দেখা এক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র by হঠাৎ দেখা এক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র by জাফরুল্লাহ চৌধুরী

আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তখন ঢাকা উত্তাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে উত্তাপটা একটু বেশি। বাইরে অফিস-আদালতের দেয়ালে পোস্টার লাগানোর পরপরই ছিঁড়ে তুলে ফেলে পুলিশ ও তাদের অনুচররা। প্রেস অর্ডিন্যান্সের কড়াকড়ির কারণে পোস্টার ছাপানো প্রায় অসম্ভব।
পোস্টার হাতে লিখতে হয়। হাতের লেখা যাদের ভালো ও পরিষ্কার, তাদের ওপরই চাপ পড়ে। মেডিকেল কলেজে আমার এক বছরের অগ্রজ মনজুর একদিন বলল, সে আর পোস্টার লিখতে পারবে না।
'আর লিখেই-বা কী লাভ! লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ছিঁড়ে ফেলছে। নতুন কোনো পথ খুঁজে বের করতে হবে। রাস্তার ওপরে লিখলে ছিঁড়তে পারবে না, অথচ সবাই সারাদিন পড়তে পারবে।' আইডিয়াটা পছন্দ হলো।
ষাটের দশকে ঢাকা শহরে গাড়ি বেশি ছিল না। পুলিশের নিজস্ব গাড়ি ছিল না বললেই চলে। রাত ১০টার পর কস্মিনকালে পথে দু'একটা গাড়ি দেখা যেত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অ্যাম্বুলেন্স।
মনজুর, চারুকলার কেরামত মাওলা, আমি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের আরও কয়েকজন রাত ১২টার দিকে মনোযোগ দিয়ে হাইকোর্ট, চামেলী হাউজ, কার্জন হল থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের বড় রাস্তায় মূলত মনজুর ও কেরামত মাওলা ২-৩ ফুট প্রস্থ বড় বড় অক্ষরে 'আইয়ুব খান মুর্দাবাদ', 'সামরিক সরকার নিপাত যাক', 'আইয়ুব শাহীর পতন চাই' ইত্যাদি লিখছে গভীর মনোযোগ দিয়ে।
সতর্কতার সঙ্গে আমরা চারদিকে লক্ষ্য রাখছি পুলিশ বা টিকটিকি আসছে কি-না। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ফর্সামতো হ্যাংলা এক যুবক অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে আমাদের কাজ দেখছে। সম্ভবত আইবির সদস্য বা থানা পুলিশের দালাল। ধর, শালাকে ধর! ধরে পিটুনি দেওয়া শুরু হবে, ঠিক এমনি মুহূর্তে যুবকটি কান্নার স্বরে বলল, 'আমি ছাত্র। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ি।' কিন্তু এখানে কেন? 'সিদ্দিকবাজারের সামনে রেলস্টেশনে চা খেতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আপনাদের দেখে থেমেছি। আমি পুলিশের লোক নই। আমি বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছি। আমি কামরুল।' তখনকার দিনে, রাতে চা খাওয়ার জন্য ছাত্ররা ঢাকা রেলস্টেশনে যেত। আমাদের কাজ শেষ হলে কামরুলকে সঙ্গে নিয়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ফিরে এলাম। মেডিকেল হোস্টেলের পাশে ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলে কামরুল ঢুকল।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ লেগে গেল। পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত। আক্রমণ প্রতিহত করে আত্মরক্ষা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কিত আলোচনার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও পূর্ব পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সম্মিলিত মিটিং হতো। মিটিং আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও উজ্জ্বল হাসিমুখে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছি '৬২-র এক রাতে হঠাৎ দেখা সুঠাম সুন্দর যুবক কামরুল ইসলামকে। আর আলাপ হয়নি। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (১৯৬৪-৬৫) সহ-সভাপতি ছিলেন বডিবিল্ডার ইস্ট পাকিস্তান এবিএম ফজলে এলাহী এবং সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল মজিদ মামুন।
মুক্তিযুদ্ধকালে আমি অধিকাংশ সময় থেকেছি ২ নম্বর সেক্টরে মেলাঘরে। ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে সুনাম কুড়িয়েছেন অপর ইঞ্জিনিয়ার টিআইএম নুরুন্নবী বীরবিক্রম। নুরুন্নবী ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। এমএ মালেক, কামাল ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ভূঁ্ইয়া ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। মালেক পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। মালেক ও কামাল উভয়ে বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। মালেক পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন নব্বইয়ের দশকে।
আমাকে কয়েকবার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে কলকাতায় যেতে হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলাপের জন্য। তখন শুনতাম বিভিন্ন ফ্রন্টে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।
শুনলাম, পশ্চিম ফ্রন্টে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে আমার ঢাকা কলেজের সতীর্থ ইঞ্জিনিয়ার কমল সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধে একটি চোখ হারিয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার মাসরুল হক ওরফে কমল সিদ্দিকী বীরবিক্রম। কমল সিদ্দিকী বিএনপির মন্ত্রী যশোহরের (মাগুরা) মেজর জেনারেল মাজেদুল হকের ছোট ভাই। মাজেদুল হকও শিবপুর থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার।
আরও একজনের সাহস ও বীরত্বের কথা শুনেছি। তিনি ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। এই সেই কামরুল, '৬২-র উত্তাল দিনের এক রাতে যার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল।
৩০ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ইপিআর, পুলিশ ও গ্রামবাসী একযোগে কুষ্টিয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে কুষ্টিয়াকে মুক্ত করেছিল এবং পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার দখল করেছিল। কুষ্টিয়া জেলা বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক সেদিনের কুষ্টিয়া ইপিআর, পুলিশ ও জনতার সম্মিলিত সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে : আশির দশকে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সঙ্গে পরিচয় গাঢ় হয় এবং অন্তরঙ্গতা জমে। বাংলাদেশ জাতীয় ওষুধনীতি-'৮২তে যুক্ত থাকার কারণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বিতর্কিত হয়ে পড়ে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর চক্রান্ত চলতে থাকে। হঠাৎ ফোন পেলাম কামরুল ইসলামের। তিনি পরিচয় দিয়ে অভিনন্দিত করলেন এবং সাহস দিলেন। আমিও লক্ষ্য রাখতে শুরু করলাম, সরকারের হাজারো রকমের লাল ফিতা ও বাঁধনের মধ্যে থেকেও কামরুল ইসলাম সিদ্দিক কী করে ১৯৮৪ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরোকে পরিবর্তন করে অধিদফতর সৃষ্টি করলেন। তিনি নিযুক্ত হলেন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী। তার সঠিক সাহসী নেতৃত্ব, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় গ্রামীণ মানুষের অধিকতর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ভাগ্যোন্নয়নে সৃষ্টি হলো হাজার হাজার মাইল গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং হাট-বাজারের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভাবনীয় বিপ্লব। চার বছরের মধ্যে প্রতিটি জেলায় তিনি তৈরি করলেন এলজিইডির নিজস্ব ভবন, প্রকৌশলীদের জন্য বাসস্থান এবং ভ্রাম্যমাণ প্রকৌশলী ও অতিথিদের জন্য সুন্দর ও আরামপ্রদ রেস্ট হাউস। বিস্তৃতি শুরু করলেন উপজেলা ও ইউনিয়নের দিকে। দাতাগোষ্ঠী সত্বর আবিষ্কার করল কর্মবীর কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে। দ্রুত এগিয়ে চলল দেশের গ্রাম ও নগরের অবকাঠামো উন্নয়ন। তিনি সব বিদেশিকে বিস্মিত করে দেখালেন একজন সরকারি কর্মকর্তার বিচক্ষণতা কী করে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্য সম্পাদন সংস্কৃতির নতুন উন্মেষ ঘটাতে হয়। সময়মতো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সফলতা বিস্ময়কর।
তার সবচেয়ে বড় অবদান স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে সারাদেশে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের জন্য দুই একর জায়গায় বিস্তৃত দোতলা ভবন নির্মাণ এবং ইউনিয়ন কমপ্লেক্সের সঙ্গে সব গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন করে সহজ যোগসূত্র সৃষ্টি।
কৃষির প্রাণ পানি। পল্লী উন্নয়নের মহানায়ক আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা সমবায় পদ্ধতির ভিত্তিতে পানি সম্পদজনিত সমস্যা, জলাবদ্ধতা নিরসন করে সেচ সুবিধা স্থানীয় উপকারভোগী জনগণকে নিয়ে 'পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি' সৃষ্টি তার অনন্য অবদান।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের আর এক অবদান হচ্ছে, তিনি অফিসের চেয়ারে আটকে থাকা আমলা মনোভাবের ইঞ্জিনিয়ারদের সামাজিক প্রকৌশলী (ঝড়পরধষ ঊহমরহববৎ) হওয়ার শিক্ষায় উদ্দীপ্ত করেছিলেন। তার সামাজিক প্রকৌশলী বাহিনী বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে হাজার হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ করে। তারা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও রাস্তা নির্মাণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হননি। তার তৈরি রাস্তা কেবল গাড়ি ব্যবহারকারীদের কাজে আসেনি। বেশি কাজে এসেছে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনে। এসব দুর্যোগকালে গরিব গ্রামবাসী রাস্তার ওপরে অস্থায়ী বাড়ি বানিয়েছে, গরুর জন্য গোয়ালঘর তৈরি করেছে এবং হাত তুলে দোয়া করেছে রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্তের পেছনের মানুষটিকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'স্বাধীনতা দিবস' পদক ও পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করতে ভুলে গেলেও দেশবাসী বিশেষত গ্রামীণ মানুষ তাকে ভোলেনি। তাদের হৃদয়ের ভালোবাসার আসনে সব সময় কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের অবস্থান উজ্জ্বল থাকবে।
২০১২ সালে আবার দেখা : গ্রামে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নভেম্বর মাসের শেষে সপ্তাহ ধরে আমি পটুয়াখালীর বাউফল, দশমিনা ও গলাচিপার বিভিন্ন ইউনিয়নে নদীর পাড় ঘেঁষে এঁকেবেঁকে যাওয়া কয়েকশ' মাইল রাস্তা গাড়িতে ঘুরেছি। রাস্তার দুই পাশে গাছের সারি। ২০-২২ বছর আগে তৈরি রাস্তার উন্নত অবস্থা লক্ষণীয় ও দর্শনীয়। কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে চেয়ারম্যানদের সঙ্গে চা খেয়েছি। বিল্ডিংয়ের কোথাও চিড় নেই। আশ্চর্য ব্যাপার! হঠাৎ মনে হলো, কার যেন হাসিমুখের ছায়া দেখলাম। যেন শুনলাম কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বলছেন, 'কি জাফর ভাই? স্বাধীনতার সুফল অর্জন করেছি কি? জাফর ভাই, আপনার সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। সৎ মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। সাহস হারাবেন না। দেশ গড়ার জন্য সাহসের সঙ্গে অনেক এগিয়ে যেতে হবে। বিপ্লবের পথ বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ। চমকে উঠলাম। চারদিকে ঘুরে তাকালাম। কই, কেউ তো আশপাশে নেই!

জাফরুল্লাহ চৌধুরী : গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান ট্রাস্টি

No comments

Powered by Blogger.