প্রতীক্ষিত রায় by জেবুন্নেছা বেগম

বাচ্চু রাজাকারের মামলার রায়ে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। একটু পরপর রেলিংয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি আর ভেবেছি, সবাই রাস্তায় নামে না কেন। এই রায়ের পর তো মিছিল হওয়া উচিত। বাংলাদেশের জন্য এটি বিরাট অর্জন। আমি ভেবেছিলাম, রায় বোধহয় দেখে যেতে পারব না।
নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জনের পর অনেক অনেক বছর পার হয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের চোখের সামনে তাদের কর্মকাণ্ড করে গেছে। তাদের বিচার দেখতে না পেরে শহীদ পরিবারের সদস্যদের মর্মবেদনা হয়েছে। এবার বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করার পর থেকেই রায়ের প্রত্যাশা করেছিলাম। অবশেষে একজনের রায় আমরা পেয়েছি। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি খুশিতে কেঁদে ফেলেছি। আমার পরিবারের সবাই খুব খুশি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা স্বজন হারিয়েছে তারা তো এ রায়ে খুশি হবেই, আমার মনে হয় বাংলাদেশের সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে পেয়ে আনন্দিত।
আমি বিচারের রায়ে যেমন আনন্দিত, তেমনই এই বিচারের ক্ষেত্রে আমার অনেক আবেগ কাজ করছে। পাশাপাশি ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বেদনাও রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চেই আমার স্বামী শহীদ হয়েছেন। আমরা তখন মোহাম্মদপুরের বাসায়। আমার স্বামী শহীদ মো. সলিমুল্লাহ্ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। একাত্তরের ২৩ মার্চ তিনি বাসার ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য আমাদের বাসায় প্রায়ই মিটিং হতো। এমনকি ২৫ মার্চ রাতেও মিটিং হয়েছিল। এই বিষয়টিই হয়তো স্থানীয় বিহারিদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। ২৬ মার্চ আমাদের বাড়ি আক্রমণ করা হয়। ছেলেমেয়েদের সামনেই আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়। ছয় ছেলে, চার মেয়েকে নিয়ে তখন আমার জীবন-সংগ্রাম শুরু হয়।
আমি সবসময় চেয়েছি বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। প্রথম রায়ে পালিয়ে যাওয়া একজনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বর্তমানে বেশ কয়েকজন গ্রেফতার আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে বাস্তবায়ন করা হোক।
এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে। হুইল চেয়ারে করে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হয়। আমি যদি পায়ে হাঁটতে পারতাম, তাহলে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও প্রদান করা হোক। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় সেই রায়ের বাস্তবায়ন দেখে যেতে চাই।
জেবুন্নেছা বেগম : শহীদজায়া

No comments

Powered by Blogger.