ফখরুদ্দিন সরকার আর নয় by রাহাত খান

বাংলাদেশে সংসদ একেবারেই কার্যকর নয়। এ জন্য দায়ী প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীর জেদ এবং অসহযোগিতা। গত রবিবার ২৬ জানুয়ারি এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তথ্য-পরিসংখ্যানসহ তিনটি দৈনিকে।
সংবাদের সত্যতা ও যথার্থতা স্বীকার না করে গত্যন্তর নেই। সংসদ কার্যকর হতে না দেয়ার পেছনে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা স্বীকার করতেই হয়। শুধু বিদ্যুত চমকের মতো একটি সন্দেহ ঝলক দিয়ে ওঠে। একই দিনে সংবাদটি প্রভাবশালী তিনটি দৈনিকে প্রায় একই কায়দায় ছাপা হওয়া কেন?
এটা কাকতলীয় ঘটনা হিসেবেও গণ্য করা চলে অনায়াসে। এ রকম তো খবরের কাগজে কখনও কখনও ঘটে। এক পত্রিকার ব্যানার হেডিং মিলে যায় অন্য পত্রিকার সঙ্গে। অনেক সময় প্রায় হুবহু একই শিরোনাম। তবে কিনা দেশে এখন বিস্তর জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে তৃতীয় শক্তির সম্ভাব্য উত্থান দিয়ে। বিশেষ করে একই গ্রুপের দুটি পত্রিকা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা-গীতি গাইছে বেশ উচ্চকণ্ঠে আর প্রকারান্তরে সংসদীয় গণতন্ত্র যে বাংলাদেশে অকেজো প্রতিপন্ন হয়েছে, এটা তথ্য-প্রমাণসহ প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। বহু লোকের ধারণা জন্মেছে, তৃতীয় শক্তির উত্থানকেই তারা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র সমাধান মনে করছে কিনা!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির রাজনীতি সাংগঠনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজনীতিতে রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির উদ্ভব ঘটলে সেটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সুফল বয়ে আনবে, এই বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতি এখনও তেমন রাজনৈতিক শক্তির দেখা পায়নি। রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি নিয়ে যে ক’জন রাজনৈতিক নেতা উচ্চকণ্ঠ; হাসিনা-খালেদা তথা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন, তাঁদের মধ্যে ক’জন আছেন যাঁরা রাজনীতিতে সাবালকত্ব অর্জন করেছেন কিনা তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে হাতেগোনা ক’জন রাজনীতিক আছেন যাঁরা সবাই রাজনীতিতে ব্যর্থ হিসেবে বিবেচিত। নির্বাচনে এরা কেউ জয়ী হওয়া দূরে থাক নিজেদের জামানত বজায় রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। অথচ ব্যর্থ রাজনীতিক, নাবালকত্ব না পেরোনো রাজনীতিক, হতাশ সাংবাদিক, কিছুসংখ্যক বাইরের পয়সা খাওয়া এনজিও কর্মকর্তা এবং সাবেক আমলাসহ সুশীল সমাজের কেউ কেউ তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়ে চলেছেন অনবরত।
রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি ঠিক আছে। বিপক্ষে বলার কিছু নেই। বরং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি একান্তভাবে দুই দলনির্ভর হয়ে গেলে দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশে কতক সময় গণতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসন এসে যায়। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে স্বাধীনতাবিরোধী দল বা জোট কোনক্রমে নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় যেতে পারলে উন্নয়ন ও সামাজিক প্রগতির নিরিখে দেশ অনেক পিছিয়ে যায়। রাজনীতিতেও সফল ও গ্রহণযোগ্য তৃতীয় অনেক শক্তি থাকলে এবং সেই দল স্বাধীনতা পক্ষের দল হলে দেশের রাজনীতি প্রভূতভাবে উপকৃত হতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই ধরনের কোন রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির উত্থান বাংলাদেশে এখনও ঘটেনি। দুই রাজনৈতিক দলনির্ভর জেদাজেদি ও আপোসহীন মনোভাবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতিতে ভবিষ্যতে তেমন কার্যকর রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়ত ধীর ক্রমে ঘটবে। কারণ সেটা আর যাই হোক, অস্বাভাবিক কিংবা অসম্ভব নয়। তবে মুশকিল, গরিব-উন্নয়নশীল দেশে তৃতীয় শক্তির উত্থান বলতে সাধারণভাবে বুঝায় সেনাসমর্থিত শক্তিকে। ব্যর্থ, অযোগ্য লোকেরা সেনাবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে দেশ পরিচালনার চেষ্টা করে। রাজনীতি চলে যায় রাজনীতির বাইরে। বাংলাদেশসহ এই ধরনের তৃতীয় শক্তির শাসন-ক্ষমতায় আসার ঘটনা অন্য দেশেও ঘটতে দেখা গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ফলাফল খুবই নেতিবাচক ও ন্যক্কারজনক। অগ্রগতি অর্জনের বদলে দেশ পিছিয়ে যায়। বহুক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়ে ওঠে লাগামছাড়া। শুরু হয় অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য উত্থান। বেশিদিন সময় পেলে এই ধরনের তৃতীয় শক্তির শাসন দেশকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। বিশ্বে এই ধরনের তৃতীয় শক্তির দেশোন্নয়নে সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত একটিও নেই।
বাংলাদেশে তাহলে এই ধরনের তৃতীয় শক্তির জল্পনা-কল্পনা কেন হয়? কেন দুটি তিনটি বা আরও বেশিসংখ্যক প্রচার-মাধ্যম জল্পনা-কল্পনাকে বাস্তবে ভাষা দিতে চেষ্টা করছে নানাভাবে?
এর মূল কারণ অবশ্যই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রায় সর্বক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়া। গণতন্ত্র বলতে অজ্ঞান অথচ বিবদমান বিষয় মীমাংসার জন্য সংলাপে বসে না। ক্ষমতায় যেতে না পারা রাজনৈতিক দল সংসদ বর্জনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মৌল শক্তিকে দুর্বল ও মৃতপ্রায় করে দেয়।
এর বাইরে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় দেশের কিছু অতি-উচ্চাকাক্সক্ষী লোকের দেশ শাসনের গোপন ইচ্ছাকে। এই ইচ্ছার কোন বৈধতা নেই। কিন্তু বৈধতা নেই তো কি হয়েছে! ক্ষমতায় যেতে পারলে বৈধতার ধার ধারে কে? সব দোষ রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দখলের বৈধতা নিয়ে দেবে তারা নিজেরাই।
উন্নয়নের পথে দ্রুত ধাবমান কোন দেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো দেশ ও জনগণের চরম দুর্ভাগ্য বই কিছু নয়। ভৌগোলিক স্থিতিশীলতার জন্য এ ধরনের ঘটনা শুধু যে দুর্ভাগ্যজনক, তা শুধু নয়, বিপজ্জনকও বটে।
বিশ্বের যে কোন স্থানে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের আরেক নাম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংসের পাশাপাশি ভৌগোলিক স্থিতিশীলতা ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া। অবৈধভাবে ক্ষমতার হাতবদল তৈরি করে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তান হওয়ার আশঙ্কা। এ নিয়ে নতুনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু নেই। অরাজনৈতিক কিংবা প্রায় অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতায় আসা বিশ্ব রাজনীতি-কূটনীতির জন্যও সর্বনাশ ডেকে আনে। ভারত কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য রাজনীতিক ছাড়া রাজনীতি, নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতা দখল গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পরে না বলেই মনে হয় আমাদের।
বাংলাদেশে নির্বাচনে জয়ী না হওয়া কোন প্রায়-রাজনীতিক কিংবা অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় যেতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য সেটা হবে বিপজ্জনক। দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের দেশটি দ্বিতীয় পাকিস্তান হয়ে উঠুক, সেটা ভারত কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে দিতে পারে না। সেটা হবে বিশ্ব কূটনীতির বিশাল বিপর্যয়।
পারে না বললাম। কিন্তু দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক প্রশ্নে আলোচনার মাধ্যমে কোন সুরাহায় পৌঁছুতে ব্যর্থ হয় তাহলে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে নির্দলীয় দাবিটি। প্রশ্ন উঠতে পারে শাসক জোট ‘নির্দলীয়’ প্রশ্নে এমন আপোসহীন কেন? বিরোধী জোটই বা কেন নির্বাচনে নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে এমন আপোসহীন? নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো নির্বাচন পরিচালনা করবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব বর্তাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর। সেক্ষেত্রে যা সুনিশ্চিত হওয়া দরকার সেটা হলো একটি অবাধ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নির্বাচন কমিশনের আছে কিনা।
এই ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলতে পারত। কিংবা নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে প্রধান তিনটি দলের নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমবায়ে একটি বহু-দলীয় সরকার গঠিত হতে পারে। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে রাজনীতির এই দু’টি অবস্থান নিয়ে আলোচনায় বিরোধী দলের অনীহা কেন তা বুঝে ওঠা কঠিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নির্দলীয় এবং অনির্বাচিত হতেই হবে, বিরোধী জোটের এই দাবী রহস্যজনক বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হয় না।
রাজনীতির বিষয় রাজনৈতিক দল বা জোটকেই মীমাংসা করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। বিবদমান জোট বা দলসমূহ গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবে এবং দেশকে নৈরাজ্য ও অস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করবে। সেটাই সর্বশ্রেণীর জনগণের কাম্য। রাজনীতি একবার রাজনৈতিক দলের বাইরে চলে গেলে ফলাফল হয় সোমালিয়া, সুদান এবং পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা। তিনটি রাষ্ট্রের একটি ইতোমধ্যেই ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। উল্লেখিত বাদবাকি দুটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে দ্রুত ধাবমান!
অরাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় এসে দেশকে কি দিতে পারে, কি সর্বনাশ ঘটাতে পারে সেটা তো আমরা ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে দেখেছি, যা আর দেখতে চাই না।

No comments

Powered by Blogger.