বাতিল হয়নি দালাল আইন- জিয়া-এরশাদের ১৭২ সামরিক ফরমানের মধ্যে বৈধতা পেল ১৬৮ অবৈধ অধ্যাদেশ by তপন বিশ্বাস

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে জারি করা ১৭২ অবৈধ অধ্যাদেশের ১৬৮টিই বৈধতা দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার।
তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে জিয়াউর রহমানের জারি করা দালাল আইন অনুমোদন করেনি সরকার। এতে দালাল আইনটি বাতিল রয়ে গেল। প্রশাসনিক সঙ্কট এড়াতে সংসদ অধিবেশনের মাত্র ৫ দিন আগে তড়িঘড়ি করে দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। দুই বছর ধরে সামরিক শাসনামলে জারি হওয়া এ অধ্যাদেশগুলো বৈধতা দিতে আইন মন্ত্রণালয় কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইন মন্ত্রণালয় প্রায় দেড় মাস কাজ করে এটি চূড়ান্ত করে।
সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ের পর আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কৌশল অবলম্বন করল সরকার। এতে একদিকে আদালতের রায়ও বহাল থাকল আবার আইনের ধারাবাহিকতাও রক্ষা করা হলো। এই কৌশল অবলম্বন করে জেনারেল জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনামলে জারি করা ১৭২ অবৈধ অধ্যাদেশের ১৬৮টিকে বৈধতা দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। ২১ জানুয়ারি (সোমবার) রাতে এই অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছে। প্রশাসনিক সঙ্কট এড়াতে জাতীয় সংসদ অধিবেশনের মাত্র পাঁচ দিন আগেই এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এতে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে জারি করা ৯১ অধ্যাদেশের তিনটি এবং এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলের ৫ অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়া হয়নি। বাকি ১৬৮ অধ্যাদেশের বৈধতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের অধীনে ইতোপূর্বে দেশের অনেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই এগুলোর বৈধতা দেয়া জরুরী হয়ে পড়ে। এছাড়া বৈধতা না দেয়া ৮ অধ্যাদেশের মধ্যে কোন কোনটি অন্য নামে ইতোপূর্বে আইনে রূপান্তরিত হওয়ায় তা বৈধতা দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। তবে বৈধতা দেয়া হয়নি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে জিয়াউর রহমানের জারি করা দালাল আইনের মতো কালো আইনের।
সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ঘোষিত মুন সিনেমা হল মামলার রায়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলে সামরিক আইন জারি, সামরিক ফরমান, আদেশ, অধ্যাদেশ, রেজ্যুলেশন ইত্যাদি জারি করে সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থার বাইরে কাজকর্ম ইত্যাদি বাতিল বলে ঘোষিত হয়েছে। তবে ওই সময়ে নির্বাহী প্রকৃতির (এক্সিকিউটিভ এ্যাকশন) কাজ, সরকারের দৈনন্দিন কাজ গৃহীত ব্যবস্থা নিষ্পন্নাধীন কার্যধারা ইত্যাদি অতীতে ঘটে যাওয়া কার্যাবলী (পাস্ট এ্যান্ড ক্লোজড) গণ্যে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে বিবেচনায় মার্জনা করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিলের মধ্যে সামরিক শাসক কর্তৃক জারিকৃত অধ্যাদেশ কর্তৃত্ববহির্ভূত বিবেচনায় বাতিল ও অকার্যকর হয়েছে। এছাড়া পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় ঘোষণার পর সংবিধানের ১৫শ’ সংশোধনীর মাধ্যমে ৪র্থ তফসিলের ১৮ ও ১৯ অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে। ওই দুটি অধ্যাদেশে জিয়া ও এরশাদ কর্তৃক প্রণীত অধ্যাদেশগুলোকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের বিরুদ্ধে সরকার রিভিউ পিটিশন দাখিল করলে আদালত এই মর্মে চূড়ান্ত আদেশ দেয় যে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে জারি করা অধ্যাদেশসমূহ মার্জনার মাধ্যমে সাময়িকভাবে বহাল রাখা হয়। ওই সময়ের মধ্যে সংসদকে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের ইঙ্গিতও দেয়া হয়। আদালতে দরখাস্ত দাখিল করে সরকার ওই মার্জনার মেয়াদ ২০১৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।
একইভাবে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এরশাদের সামরিক শাসনামলে জারি করা ফরমান, আদেশ, অধ্যাদেশ ইত্যাদি হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং ৬৯৬/২০১০-এ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী সংবিধানের ৭ম সংশোধন ১৯৮৬ অবৈধ, এখতিয়ার বহির্ভূত, শুরু থেকে বাতিল ও বে-আইনী ঘোষণা করেন। এমনকি অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে গণ্য করে ফৌজদারি অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য সরকারকে বলা হয়। হাইকোর্ট বিভাগের এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের ৪৮/২০১১ নং সিভিল আপীল মামলার রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক এবং অন্যান্য বিচারক এই মর্মে রায় ঘোষণা করেন যে, সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল বলে গণ্য হবে। এরশাদের আমলে জারি করা ফরমান, আদেশ, অধ্যাদেশ ইত্যাদি অতীতে ঘটে যাওয়া কার্যাবলী গণ্যে তার অধীনের কাজকর্ম ব্যতিক্রম ক্ষেত্র বিবেচনায় মার্জনা করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। এরশাদের আমলের অধ্যাদেশসমূহের অধীনে কাজকর্ম মার্জনা করা হলেও ওসব অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে ৫ম ও সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলের ৯১ এবং এরশাদের সামরিক শাসনামলের ৮১ মোট ১৭২ বহুল প্রচলিত আইন অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। প্রশাসনিক সঙ্কট এড়াতে সরকার ওই সব অধ্যাদেশ পুনর্বহাল করতে বিশেষ বিধান আইন ২০১৩ প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়। সোমবার তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভের পর এটিকে অধ্যাদেশ আকারে দ্রুত জারির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পর রাতে রাষ্ট্রপতি এতে স্বাক্ষর করেন। গভীর রাতে আইন মন্ত্রণালয় এটি বিজি প্রেসে পাঠায়।
এই অধ্যাদেশ জারির পর প্রশাসনিক সংকট বা আইনী শূন্যতা দূর হলো। এতে জনগণের অধিকার খর্ব হওয়ার আর কোন সুযোগ থাকল না। এই অধ্যাদেশ জারির কারণে আয়কর বা অন্যান্য অর্থ সংশ্লিষ্ট আইন, ভূমি অধিগ্রহণ, সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত, এসএসএফ গঠন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আর কোন জটিলতা সৃষ্টির সুযোগ নেই।
বিগত সামরিক শাসনামলে জারি করা অধ্যাদেশের বৈধতা দিলেও ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জারি করা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে দালাল আইন রহিতকরণ অধ্যাদেশটি সরকার অনুমোদন করেনি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারি করা দালালদের বিচার সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল আইন (পি ও-৮) বহাল থাকল।

No comments

Powered by Blogger.