এখন যারা অপেক্ষায়- কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা যে কোন দিন by বিকাশ দত্ত

 মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২-এ বিচারিক ও তদন্তসহ ১৪ মামলার মধ্যে বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের মামলার রায় হয়েছে।
এখন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষাধীনে (সিএভিতে) রাখা হয়েছে। যে কোন দিন তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হবে। রায় ঘোষণার আগের দিন জানিয়ে দেয়া হবে। পাশাপাশি আরও ৭টি মামলার অগ্রগতি রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযুক্ত আরও ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২-এ ৭টি মামলার মধ্যে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে পুনরায় যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) আজকের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। যুক্তিতর্ক শেষ হলেই মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ করা হবে। অর্থাৎ এই মামলা এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিম ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য সিএভিতে রেখেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করায় আসামি পক্ষ পুনর্বিচারের জন্য আবেদন করে। কিন্তু তাদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। শুধু সাঈদীর মামলায় নতুন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আদেশ দেয়া হয়। নিচে মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থান দেয়া হলো।
আব্দুল কাদের মোল্লা ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক শেষ হয়ে এখন রায় ঘোষণার জন্য সিএভিতে রাখা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা করা হয়। এর পর ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল। ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর ফরমাল চার্জ দাখিলের আবেদন। ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয়। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ মামলা স্থানান্তর। ২০১২ সালের ২৮ মে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ষড়যন্ত্র, উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি পুনর্বিচারের আবেদন। ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি আবেদন খারিজ। ১৭ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক শেষ। রায় ঘোষণার জন্য সিএভিতে রাখা হয়েছে।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ॥ জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা একেবারে শেষ পর্যায়ে। মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল আজ বুধবার মধ্যে তার পক্ষে যুক্তিতর্ক শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে যুক্তিতর্ক শেষ হলেও মামলাটি পুনরায় যুক্তিতর্ক করা হচ্ছে। এক নজরের সাঈদীর মামলা। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে পিরোজপুর আদালতে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। ২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদীকে গ্রেফতার করা হয়। ২ নবেম্বর ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ জুলাই ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হয়। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেন। ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর গণহত্যা, হত্যাসহ ২০টি অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে তার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ। একই বছরের ৫ নবেম্বর প্রসিকিউশন পক্ষের যুক্ততর্ক শুরু। ১৭ নবেম্বর আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু। ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সম্পন্ন। রায় ঘোষণার জন্য সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সিএভিতে রাখেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ব্যক্তিগত কারণে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করায় আসামি পক্ষ পুনর্বিচারের আবেদন করে। ৩ জানুয়ারি পুনর্বিচারের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এর পর শুধু সাঈদীর মামলায় নতুন করে যুক্তিতর্ক শুরু করার আদেশ দেয়া হয়। প্রসিকিউশন পক্ষ যুত্তিতর্ক শেষ করেছে। এখন আসামি পক্ষ যুক্তিতর্ক করছে।
গোলাম আযম ॥ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ২০০০ সাল পর্যন্ত দলের নেতা ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গণহত্যার অভিযোগ এনেছেন। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানান। এ আবেদন নাকচ করে দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১২ সালের ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৫টি চার্জ গঠন করা হয়েছে। চার্জ-১-এ ৬টি ঘটনা উল্লেখপূর্বক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) জি-ধারার সঙ্গে ৪ (১) ও ৪ (২) ধারা যড়যন্ত্রের অভিযোগ। চার্জ-২-এ তিনটি ঘটনা উল্লেখপূর্বক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন এর ৩(২) (এফ) ধারায় অপরাধ সংঘটনের পরিকল্পনা ও অভিযোগ, চার্জ ৩ এ ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করে উপরোক্ত আইনের ৩ (২) (এফ) ধারায় এবং ৪ (১), ৪ (২) ধারায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগ। চার্জ ৪ এ ২২ টি ঘটনা উল্লেখপূর্বক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩ (২) (এইচ) ধারার সঙ্গে ৪ (১) ৪ (২) ধারায় অপরাধ সংঘটনের সম্পৃক্তির অপরাধ। চার্জ ৫-এ উপরোক্ত আইনের ৩ (২) (এ) ধারায় হত্যা-নির্যাতনজনিত মানবতাবিরোধী অপরাধ দেয়ার অভিযোগ।
এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে ১৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সাক্ষীরা হলেন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম ওরফে এসপি মাহাবুব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বাংলা একাডেমীর সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিঞা, সেলিনা আফরোজ, কাজী আইয়ুব, ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, এসআই আমিনুল, জামিনুর শেখ, শাফিউদ্দিন আহম্মেদ, সোনা মিয়া, আনোয়ারা বেগম, বিশিষ্ট সুরকার ও গীতিকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং শেখ ফরিদ আলম। আসামিপক্ষের আইনজীবী তাদের জেরার কার্যক্রমও শেষ করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করে।
সাকা চৌধুরী ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর এমপির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা এখন শেষ পর্যায়ে। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। ২০১০ সালের ২৬ জুলাই সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। তাকে গ্রেফতারের জন্য ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে তদন্ত সংস্থা। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাড়ি পুড়িয়ে যাত্রী হত্যার এক মামলায় এ সংসদ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগেও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ ২৩ অপরাধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। এখনও তার বিরুদ্ধে মামলা প্রায় শেষের দিকে।
আব্দুল আলীম ॥ বিএনপির আরেক নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে এখন মামলা চলছে। তার বিরুদ্ধে এ পর্য্যন্ত ৯ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করা ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়াসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আব্দুল আলীম মানবতাবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত হলেন। তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হলো। ট্রাইব্যুনাল আন্তজার্তিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩ (১), ৩ (২) (এ) (সি) (জি), ৪ (১), ২০ (২) ধারায় অভিযোগ এনেছে। এ পর্যন্ত যারা তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছেন সবাই আলীমের বিরুদ্ধে হত্যা-নির্যাতনের কথা তুলে ধরছেন।
মুজাহিদ ॥ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১২ সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য শেষ করেছেন। ২০১২ সালের ২১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ, দেশত্যাগে বাধ্য করা ও অগ্নিসংযোগের দায়ে সাতটি অভিযোগ গঠন করে। এর মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত হলেন, এখন তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়। ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩ (১), ৩ (২) (এ) (সি) (জি), ৪ (১), ৪ (২) ২০(২) ধারায় অভিযোগ এনেছে।
একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা। আসামির পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭/৮ জন যুবক তাঁকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। আজঅবধি তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ এর ৩(২) (এ) (জি) এবং ৪(১), ৪(২) ধারায় বর্ণিত অপরাধ করেছে। উক্ত আইনের ২০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছেন। এ ছাড়া আরও অভিযোগ রয়েছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে।
নিজামী ॥ জামায়াতের বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৬ অভিযোগ গঠন করা হয। ট্রাইব্যুনাল-১ প্রায় দেড় ঘণ্টার আদেশে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ পড়ে শোনান। ১৬ নম্বর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রেসিডেন্ট ও আল বদরের প্রধান হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্য ১৫টি অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা করা, ষড়যন্ত্র করা ও উর্ধতন নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩-এর ৩(২)(এ), সিজিএইচ এবং ৪(১) ও) ২) ধারায়এসব অভিযোগ গঠন করা হয়। অন্যদিকে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, হত্যা, চর্টার এর অভিযোগ আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩ এর ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) ধারায় এসব অভিযোগ গঠন করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১২ সালের ২৮ মে তাঁর বিরুদ্দে বুদ্ধিজীবী হত্যা, হত্যা, গণহত্যাসহ ১৬টি অভিযোগ আনা হয়। এ পর্যাপ্ত প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা শেষ হয়েছে। এখন দ্বিতীয় সাক্ষীর জবাবনবন্দী চলছে। মামলাটি এখন মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। অভিযোগে বলা হয, ১৬ জুন ১৯৭১ সালে নিজামীর পাবনা জেলার স্কুলের হেড মাওলানা কছিমউদ্দিন আহম্মেদসহ অন্য দুইজনকে ইছামতি নদীল পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাবনা জেলার আতাইকুলা থানার মাধবপুর গ্রামের ইছামতি নদীর পাড়। সেখানে একাত্তরের ১৬ জুন গুলি করে হত্যা করা হয়, পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা কছিমুদ্দিন আহম্মেদকে। ৪ জুন সকাল বেলা উল্লাপাড়া যাওয়ার জন্য বাস যোগে রওয়ানা করেন। পাবনা থেকে বের হওয়ার সময় মোসলেম খাঁর তেমাথার মোড়ে অবস্থিত পাকিস্তান আর্মির চেকপোস্টে আর্মিরা তাঁকে বাস থেকে নামিয়ে পাবনা শহরের নুরপুর ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আসামি মতিউর রহমান নিজামীর উপস্থিতিতে ও ইঙ্গিতে তাঁর উপর সীমাহীন নির্যাতন চলে। এর পর একাত্তরের ১০ জুন ভোর অনুমান ছয়টায় মাধপুর আর্মিক্যাম্পসংলগ্ন ইছামতি নদীর পাড়ে অজ্ঞাত দুই সঙ্গীসহ তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি পাবনা জেলার একজন বিশিষ্ট সমাজ সেবক ছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে রাজাকার আসাদের সহায়তায় পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনী ডেমরা ও বাউশগাড়ি গ্রামে প্রায় ৪৫০ জন নিরীহ নারী পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন সেখানে কয়েকজন মহিলাকেও ধর্ষণ করা হয়। একাত্তর সালের ১৪ মে শুক্রবার পাবনা জেলার সাথিয়া থানার বাউশগাড়ি গ্রামে ভোরে ফজরের আজানের পর নিজামী বেলা ১১টায় মিটিং ডাকে। সেই মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বর্বরোচিত হত্যাকা- ঘটানো হয়। নিহতদের বড় গর্তে জড়ো করে তাদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করা হয়।
কামারুজ্জামান ॥ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয়। ২০১০ সালের ২১ জুলাই থেকে তদন্ত শুরু। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হলেন আব্দুর রাজ্জাক। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তার প্রসিকিউটশনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল। ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল। ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তদন্তের জন্য আবার প্রসিকিউশনে ফেরত পাঠান। ২০১২ সালের ১২ জানুযারি পুনর্বার অভিযোগে দাখিলের আবেদন। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ২ এ স্থানান্তর। ২০১২ সালে ২৫ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-২এ কার্যক্রম শুরু। ২০১২ সালের ৫ জুন হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ ৭টি অভিযোগ গঠন। ২০১২ সালের ২ জুলাই থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু। এখন পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্দে ১৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এখন যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী, বাগেরহাটের একেএম ইউসুফ, হবিগঞ্জের সাবেক এমপি সৈয়দ মোহাম্মদ কাওসার, রাউজানের গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যশোরের মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, জামায়াত নেতা আব্দুস সোবহান মিয়া, এটিএম আজহারুল ইসলাম, এম এ জাহিদ হোসেন খোকন, মোবারক হোসেন, আমজাদ মিনা ও লাহার আলী শাহ। এদের মধ্যে শর্তাসাপেক্ষে জামিনে আছেন বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম, মোবারক হোসেন ও রুস্তম আলী সিকদার। গ্রেফতার রয়েছেন, মীর কাশেম আলী, আব্দুস সোবহান মিয়া, এটিএম আজহারুল ইসলাম, আমজাদ মিনা ও লাহার আলী শাহ।
২০১২ সালের ২৫ মার্চ মানবতাবিরোধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। মামলার সংখ্যা বাড়ার কারণে ২০১২ সালের ২৫ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। বর্তমানে দুটি ট্রাইব্যুনালে বিএনপি ও জামায়াতের মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে বিচার কাজ চলছে। তদন্ত সংস্থার প্রধান এমএ হান্নান খান জনকণ্ঠকে বলেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা আরও তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করব। এরগুলো হলো জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাজী মোবারক ও ফরিদপুরের খোকন রাজাকার। ইতোমধ্যে এটিএম আজাহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজী মোবারক জামিনে রয়েছেন।
৬৪০টি আবেদন ॥ তদন্ত সংস্থায় সর্বমোট ৬৪০টি অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্য থেকে মামলাগুলো যাচাই বাছাই করে তদন্ত করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এগুলো যাচাই বাছাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন ইতমধ্যে আমরা বাগেরহাটের শরণখোলায় মাওলানা একেএম ইউসুফ-এর বিরুদ্ধে তদন্ত করেছি। তাঁর বিরুদ্ধে আরও তদন্ত করতে হবে। প্রাথমিক তদন্তেই তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাওলানা একেএম ইউসুফ খুলনা অঞ্চলের শান্তিকমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনিই প্রথম রাজাকার সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত, রাজাকাররা খুলনাতেই বেশি নৃশংস চালিয়েছে। খুলনা এলাকাতেই পাক হানাদার বাহিনীর সতায়তা ছাড়া রাজাকাররা হত্যা লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েছে। তিনি বলেন তদন্ত শেষে আমরা তাঁর বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রদান করব।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই নায়ক ॥ মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই মূল ঘাতক চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রসিকিউশনের কাছে জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত সংস্থায় সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে বলে জানা গেছে। তদন্ত সংস্থার প্রধান এমএ হান্নান জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা গত বছরের অক্টোবরে বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রতিবেদন প্রসিকিউশন শাখায় জমা দিয়েছে। এদিকে প্রসিকিউশন থেকে জানা গেছে তারা প্রতিবেদন চূড়ান্ত যাচাই বাছাই করতে আরারও তদন্ত সংস্থায় পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়টি অস্বীকার করে হান্নান খান বলেছেন, আমরা অনেক আগেই বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দিয়েছি। যদি প্রসিকিউশন পক্ষ থেকে বলে তা হলো আরও তদন্ত করা যাবে।
তদন্তকারী সংস্থার প্রধান এমএ হান্নান খান বলেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জমান দু’জনেই বিদেশে অবস্থান করছেন। চৌধুরী মইনুদ্দিন থাকেন ইংল্যান্ডে আর আশরাফুজ্জামান আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এই দুই জনেরই বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. মুনিরুজ্জামান, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ড. মুর্তজা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. রশিদুল হাসান, ড. ফজলুল মহিউদ্দিন, ড. আবুল খায়ের, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন, সাংবাদিক আনম গালাম মোস্তফা, অধ্যাপক সিরাজুল হকসহ অন্য বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। আলবদর বাহিনীকে সহায়তা করেছে চৌধুরী মইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান।
এই দু’জন ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতার উষালগ্নে ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আল-বদর বাহিনীর চীফ এক্সিকিউটর বা ‘প্রধান জল্লাদ’ ছিল আশরাফুজ্জামান খান আর অপারেশন ইনচার্জ ছিল চৌধুরী মাঈনুদ্দীন।

No comments

Powered by Blogger.