ধর্ষকের কোন দল, জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব নেই by গোলাম কুদ্দুছ
কলকাতার তারা টিভিতে তরুণদের একটি গানের অনুষ্ঠান দেখছিলাম। সমাজ সচেতন মনে হলো সবাইকে। সম্প্রতি দিল্লীতে এক মেডিক্যাল ছাত্রীকে গণধর্ষণ, গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া এবং সর্বশেষ তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতব্যাপী বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সহিংস আচরণের এ প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেসনেত্রী সোনিয়া গান্ধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন। ইতোমধ্যে ছয় ধর্ষণকারীকে গ্রেফতার এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এই ধর্ষণের ঘটনা সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষ বিশেষ করে তরুণদের আলোড়িত ও আবেগতাড়িত করেছে। আলোচ্য টিভি অনুষ্ঠানে ‘আকাশ’ নামে এক তরুণ তার লেখা, সুর করা ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদী এক গানে তথাকথিত শিক্ষিত, সচেতন নাগরিকদের পৃষ্ঠদেশে বেত্রাঘাত করেছে বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। আকাশের গানের প্রতিটি শব্দ, উচ্চারণ, শারীরিকভাষা যেন গিটারের তারগুলোকে ছিঁড়ে এক একটি চাবুকে পরিণত করেছে। ধর্ষক এবং খুনীদের প্রতিরোধ না করে প্রদীপ বা মোমবাতি প্রজ্বলনকে ঘৃণাভরে পরিহাস করেছেন তরুণ আকাশ। তার আবেগ এবং ক্ষোভমিশ্রিত গানের প্রতিটি মুহূর্ত শ্রোতাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে, আবেগে উদ্বেলিত করেছে।আকাশের এ আবেগ শুধু তার একার নয়। এ আবেগের অংশীদার পৃথিবীর প্রতিটি তরুণ-তরুণী এবং বিবেকসম্পন্ন মানুষ। ধর্ষণ শুধু দিল্লী, পাঞ্জাব, বিহার, মেদিনীপুর, কুচবিহার, টাঙ্গাইল, নীলফামারী, রাজবাড়ী এবং ঢাকার শাহআলীবাগ কিংবা খিলগাঁওতে সীমাবদ্ধ নেই। কম-বেশি পৃথিবীর প্রতিটি দেশে, প্রতিটি লোকালয়ে ধর্ষণ আছে। ধর্ষকদের কোন দল নেই, জাতীয়তা নেই, নাগরিকত্ব নেই তার পরিচয় সে শুধুই একজন ধর্ষক। এই ধর্ষণ বন্ধ এবং ধর্ষকদের নিবৃত্ত ও প্রতিরোধ করাই আজ সবচাইতে জরুরী।
বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার আধুনিকায়ন, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নানা ধরনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে সময় নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও উদ্বেগজনক ঘটনায় জাতি বিব্রত ও বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, রাজনৈতিক সহিংসতা ও নারী ধর্ষণের মতো বর্বর ঘটনা জাতির কপোলে কলঙ্কতিলক এঁকে দিচ্ছে। বিশেষ করে নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে হত্যার ক্রমবর্ধমান ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। অনৈতিক, বর্বর, পশুসুলভ এ সব ঘটনা সভ্যসমাজে অচল, মনুষ্যসমাজে নিন্দনীয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষের অবশ্য করণীয় হচ্ছে এ সব অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এ দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার, অপরাপর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং অন্যান্য ব্যক্তি ও সংগঠনকে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। প্রচারণা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমেই ধর্ষণের মতো অপরাধকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হবে।
আমাদের মতো দেশে ধর্ষণ শুধু বিকৃত রুচি এবং সন্ত্রাসী আচরণের কারণেই ঘটছে না, কখনও কখনও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় দু’লাখ নারী পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদরদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে এসব ধর্ষণকে সেসময় জায়েজ করার চেষ্টাও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত এ সব নারী এখনও ধর্ষণের বিচার পায়নি। উপরন্তু ধর্ষণকারী এবং ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র ও সমাজে বুক উঁচু করে চলেছে এবং প্রতিনিয়ত আমাদেরকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সবক দিচ্ছে। আমরা ধর্ষিত নারীদের বীরাঙ্গনার অঘোষিত খেতাব দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ করেছি। স্বাধীনতার পর একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বীরাঙ্গনাদের নিজের মেয়ে সম্বোধন করে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক নারকীয় ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রচেষ্টারও যবনিকা ঘটে পুনরায় কপাল ভাঙ্গে ধর্ষিত এই নারীদের। রাষ্ট্রের কি কোন দায় নেই-এই নারীদের দেখভাল করার? এখনও যারা জীবিত আছে, আর্থিক দৈন্যদশায় কাটছে প্রতিটি মুহূর্ত তাদের পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্র কি কোন উদ্যোগ নেবে না? প্রতিবছর অপ্রয়োজনীয় বিলাসবহুল খাতে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকাই তো ব্যয় হয়; আমরা কি পারি না সেই টাকার অন্তত একটি অংশ এই বীর মাতাদের কল্যাণে ব্যয় করতে? বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের কাছে আমরা এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ প্রত্যাশা করি।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একটি বড় অংশ প্রতিদিন গণমাধ্যম এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সত্য-মিথ্যা অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। মানবাধিকার রক্ষায় তাদের উদ্বেগ-ব্যাকুলতাকে প্রশংসা করি, আবার বিস্মিত হই যখন দেখি একাত্তরের গণহত্যা এবং নারী ধর্ষণকারীদের বিচার প্রসঙ্গে তারা নীরবতা অবলম্বন করেন। এই প্রগতিবাদী বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই জীবনে একবারের জন্যও যুদ্ধাপরাধী এবং ধর্ষণকারীদের বিচার দাবি করেননি। মানবাধিকারের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা জমে যায়, কিন্তু একাত্তরের গণহত্যা এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকা-ের বিচার দাবি করাকে এরা দায়িত্ব মনে করেন না। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচনের পর শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে অনেক নারী ধর্ষিত হয়েছে। মাহিমা, ফাহিমা, পূর্ণিমা, স্মৃতিকণা আর সাত বছরের কিশোরী রজুফার কথা কি আমরা ভুলে গেছি? সারাদেশে অসংখ্য রজুফা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীর সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেয়ার বর্বর ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন যখন দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছে তখনও সুশীল সমাজের চিহ্নিহ্নত অংশটি ‘টু’ শব্দটি করেননি। এদের মানবাধিকারের তত্ত্ব বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত। এরা সবসময় সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলেন না। এই জ্ঞানপাপী মানুষগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ এরা মিথ্যার কথামালায় মানুষকে বিভ্রান্ত করে সত্য, ন্যায় এবং প্রগতির চাকা রুদ্ধ করতে সদা সক্রিয়।
সত্যাশ্রয়ী আদর্শবান নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে নির্মোহ দৃষ্টিতে সমাজকে দেখা, মানুষের ক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা। মানবসমাজকে মানবিক সমাজে পরিণত করার নিরলস সংগ্রামে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত চিন্তা এবং স্বার্থকে পরিহার করে সর্বজনীন স্বার্থকে মর্যাদা দিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে সব জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষের নিরাপদ আবাসে পরিণত করতে হবে। শ্রেণীবৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে এনে সব মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং নারী-পুরুষের অসাম্য দূর করার নিরন্তর সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু মুখে মুখে নয়, যারা সত্যিকার অর্থেই প্রগতির পতাকাকে অন্তরে ধারণ করেন তাদের এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে নারীর ওপর সহিংস আচরণ, এ্যাসিড নিক্ষেপ ও ধর্ষণের মতো অমার্জনীয় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ধর্ষকদের রক্ষা ও প্রশ্রয় দেয়া সমাজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এবং নারীর আত্মমর্যাদা ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে ব্যাহত করবে। তাই আজ শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস সময়ের দাবি।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট
E-mail: gquddusbd@gmail.com
No comments