পরাজিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

গণতন্ত্র না হলে সিভিল সমাজ হয় না, আর সিভিল সমাজ শক্তিশালী না হলে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয় না। রাজনীতি স্বৈরতান্ত্রিক হলে সমাজের সিভিলিটি নষ্ট হয়, আর নষ্ট সমাজ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে ব্যর্থ হয়।
গণতন্ত্র সিমেন্টের মতো কাজ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে। গণতন্ত্রের সামাজিক ও বাস্তবিক ভূমিকা এখানেই। আমরা মানুষের সম্পর্কে বাস্তবতা বুঝি, আর মানুষ যেহেতু ইতিহাস থেকে উদ্ভূত, সেজন্য বাস্তবতা এই অর্থে ইতিহাসের বিষয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির কেন্দ্র হচ্ছে পপুলার নিয়ন্ত্রণের র‌্যাডিক্যাল বিস্তৃতি ঘটানো। এসব নিয়ন্ত্রণের অনেক ধরন থাকতে পারে (আমাদের বড় দুটি দল কোন্ কোন্ ধরনের ভেতর কাজ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই দুই দল কি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল? দুই দল কি পরিবর্তনের জন্য সরকার ও পার্লামেন্টের ওপর নির্ভরশীল? কিছু পরিবর্তন তো জারিত হয় আইনের শাসনের মধ্য দিয়ে, দুই দল আইনের শাসনের ওপর কত দূর পর্যন্ত বিশ্বাসী? কিছু পরিবর্তন তো আবার সংস্কৃতির মাধ্যমে তৈরি হয়, এই তৈরি হওয়া কত দূর পর্যন্ত দুই দল গ্রহণ করে থাকে? এসব পরিবর্তনের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তর থেকে পপুলার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্মাণ করা। কিন্তু বাস্তবের রাজনীতিতে এ সব পরিবর্তন খুঁজে পাওয়া যায় না। যেটি পাওয়া যায় সে হচ্ছে রাজনীতির স্বৈরতান্ত্রিকতা।
কথাটা শুম্পিটারের : গণতন্ত্র হচ্ছে সেই ব্যবস্থা সেখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব ভোটের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিরা কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা অর্জন করে থাকে। ক্ষমতা সে জন্য ভোট ও ভোটের প্রতিযোগিতা। এর বাইরে কোন ক্ষমতা নেই। এর পরপারে আছে রাজনীতির স্বৈরতান্ত্রিকতা। কোন কিছু না মানবার প্রবণতা। এই প্রবণতা কি খালেদা জিয়ার মধ্যে জোরদার হয়ে উঠছে না? রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমাজকে ধরে রাখে। এই ধরে রাখাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের সমাজকে ধরে রাখার কৌশল নষ্ট হয় যদি কোন রাজনৈতিক দলের একরোখামি চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছায়। রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস যদি একরোখামি হয় কিংবা সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা হয়, তাহলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায়, দেখা দেয় স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রকে ঘিরে ধেই ধেই করে নাচতে থাকে যুবক ও যুবতী, যাদের নাচ দেখে মনে হয় সংসারে তাদের আর কোন কাজ নেই, হুকুমের নাচ হচ্ছে তাদের ধ্যানমন সংসার, লেখাপড়া, ব্যবসাবাণিজ্য তাদের কর্তব্যের অংশ নয়।
এভাবে কি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে? সম্ভব হবে না। গণতান্ত্রিক অধিকারের দুই দিক আছে। একদিকে আছে সেইসব অধিকার যেসব ব্যক্তির অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান করে, অন্যদিকে আছে সেইসব অধিকার যা সমষ্টিবদ্ধ। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা খালেদা জিয়ার রাজনীতির স্ট্র্যাটেজি নয়। তার স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ক্ষমতা দখল। যে রাজনীতির লক্ষ্য ক্ষমতা দখল, সে রাজনীতির অবস্থান গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে। এই অবস্থান সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে নির্যাতন শক্তিশালী করে তোলে। নির্যাতন ও গণতান্ত্রিক অধিকার পরস্পরবিরোধী। বিএনপি প্রথম থেকে নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একটা সত্য ভাববার মতো। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। খালেদা জিয়া, এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে টালবাহানা করা শুরু করেছেন (টালবাহানার স্বরূপ হচ্ছে : বিচারের স্বচ্ছতা ও বিচারের আন্তর্জাতিক মানের কথা তোলা)। হত্যাকারীদের পক্ষে স্বামী-স্ত্রীর সহমর্মিতা বাংলাদেশের ইতিহাস বোঝার জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। জামায়াতের রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়া ও বিএনপি অনেক কিছু শিখেছে। তেমনই বিএনপি ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি থেকে জামায়াত অনেক কিছু শিখেছে। শেখার বিষয় হচ্ছে : রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক। রাষ্ট্র কর্র্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক, কিছুতেই গণতান্ত্রিক নয়। ব্যক্তি কর্র্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রজা। এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়া দুজনই প্রবর্তন করেছেন। পাকিস্তান আমলে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে বাংলাদেশের উদ্ভবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং পরাজিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই পরাজিত রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে জামায়াতে ইসলামী প্রথমে জিয়াউর রহমানের সেনা শাসনের পক্ষে এবং পরবর্তীতে খালেদা জিয়া ও বিএনপির রাজনীতির পক্ষে পরাজিত রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাচ্ছে। লিবারেল গণতন্ত্র ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, শেষ পর্যন্ত শ্রেণীসংগ্রামে কোন্ পক্ষে যাওয়ার বাছাই করার লড়াই। লিবারেল গণতন্ত্রে কোন্ কোন্ দিক মূল্যবান তা নির্ভর করে রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের ওপর। জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাজনৈতিক প্র্যাকটিস এবং খালেদা জিয়া অনুসৃত রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাজনৈতিক প্র্যাকটিস, খুনী রাষ্ট্রতত্ত্ব ও খুনী রাজনৈতিক প্র্যাকটিস। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তির পক্ষে খুনী রাষ্ট্রতত্ত্ব ও খুনী রাজনৈতিক প্র্যাকটিস সমর্থন করা সম্ভব নয়।
জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে কোন তফাত আছে কী? একটা স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি একটা পরাজিত রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনের পক্ষে কাজ করে চলেছে। যত দিন যাবে ততই জামায়াতের রাষ্ট্রতত্ত্ব ও বিএনপির রাষ্ট্রতত্ত্ব পরস্পর প্রবিষ্ট হয়ে যাবে। এই পরস্পর প্রবিষ্টতা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক, সুদূরপ্রসারী নৈরাজ্যের উদ্গাতা হয়ে উঠবে এই পরাজিত রাষ্ট্রতত্ত্ব। খালেদা জিয়া ও বিএনপি এই পরস্পর প্রবিষ্ট বারুদের দায়ভাগ এড়াতে পারবে না। পরস্পর প্রবিষ্ট পরাজিত রাষ্ট্রতত্ত্ব তৈরি করে চলেছে এবং তৈরি করবে গণহত্যার পশ্চাদস্পট, এথনিক ক্লিনিজং-এর সর্বনাশা যুক্তিজাল। এথনিক ক্লিনিজং-এর রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে ভারত বের হতে পারছে না, পাকিস্তান বের হতে পারছে না, ইরাক বের হতে পারছে না, তুরস্ক বের হতে পারছে না, আয়ারল্যান্ড বের হতে পারছে না। হিন্দু, মুসলমান, শিয়া সুন্নি, তুর্কী, কুর্দী, প্রটেস্ট্যান্ট, ক্যাথলিক কি মূল্যবান? না মূল্যবান মানুষ, বিশ্বাস দর্শন নির্বিশেষে মানুষ? মানুষের বিরুদ্ধে এথনিক ক্লিনজিং হয় বলেই মানুষবিরোধী সর্বনাশা দৃষ্টিভঙ্গি জার্মানিতে নিষিদ্ধ, ফ্রান্সে নিষিদ্ধ, ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ, ইতালিতে নিষিদ্ধ। এ কারণেই বাংলাদেশে জামায়াত ও বিএনপির পরস্পর প্রবিষ্টতা থেকে উদ্ভূত মানুষবিরোধী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। মানুষকে যদি বাঁচাতে হয়, মনুষ্যত্ব যদি রক্ষা করতে হয়, সভ্যতা যদি টেকাতে হয় তাহলে খালেদা জিয়া অনুসৃত, গোলাম আযম অনুসৃত, সাঈদী অনুসৃত রাজনীতি উচ্ছেদ করতে হবে। এই রাজনীতি উদ্ভূত রাষ্ট্রতত্ত্ব মানুষকে ক্রমাগত অমানুষ করে চলেছে। অমানুষদের রাষ্ট্রে মানুষ বাঁচে না। মানুষ হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, শিয়া কিংবা সুন্নি নয়, তুর্কী কিংবা কুর্দী নয়, ক্যাথলিক কিংবা প্রটেস্ট্যান্ট নয়, শ্বেতাঙ্গ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ নয় : মানুষ কেবল মানুষ। এই অবস্থানের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায়, তাদের নিয়তি বাচ্চু রাজাকার হওয়া, দোজখের আগুন তাদের স্থায়ী বাসস্থান। সেজন্য বজ্র থেকে আওয়াজ কেড়ে নিয়ে বলার সময় এসেছে : যারা গণহত্যা করে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তাদের আশ্রয় দেয়া যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.