‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্য-গ্রহ শক্তির উদ্বোধন’ by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নুরেমবার্গের আদালতে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়, তখন ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে নাকি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি তো মৃত্যুদ-ের বিরোধী।
তাহলে নুরেমবার্গ আদালতের এই রায় সমর্থন করেন কি?’ রাসেল নাকি জবাব দিয়েছিলেন, ‘ব্যক্তিগত খুনের ব্যাপারে আমি মৃত্যুদ-দানের বিরোধী। কারণ অনেক সময় অনেক অপরাধী সাময়িক উত্তেজনা ও রাগের বশে প্রতিশোধ কামনায় হত্যাকা- ঘটায়। এ ক্ষেত্রে আমি কঠোর শাস্তি চাই, মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু সমষ্টিগত যে হত্যাকাণ্ড, যা ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয় এবং যে নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে নারী, শিশুও বাদ যায় না, তা ব্যক্তিমানুষের বিরুদ্ধে নয়, সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই অপরাধে মৃত্যুদ- লঘু শাস্তি।’
পাঠক ভাই-বোনেরা লক্ষ্য করবেন, মৃত্যুদ- সম্পর্কে বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে আমি দুবার নাকি শব্দটি ব্যবহার করেছি। তার কারণ আমি রাসেলের কোন লেখায় এই মন্তব্যটি পাঠ করিনি। কিন্তু রাসেল-গবেষক এক ব্রিটিশ বন্ধুর কাছে শুনেছি। রাসেল সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটন করে তিনি পত্রপত্রিকায় লিখেছেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য নেতাকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করে তাদের বিচারের জন্য রাসেল যে গণআদালত তৈরি করেছিলেন তার অনুকরণে বাংলাদেশে ’৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের বিচারের জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত ’৭১-এর ঘাতক দালালদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ঢাকায় গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে এই অপরাধীদের মক্ ট্রায়ালের ব্যবস্থা করেছিল। এই গণআদালতেও নরপশু গোলাম আযমসহ ’৭১-এর মানবতার শত্রুদের ফাঁসির আদেশের সুপারিশ করা হয়েছিল।
তখন বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে এই গণআদালতের সুপারিশকে কিছুমাত্র সম্মান দেখানোর পরিবর্তে এই আদালতের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য জাহানারা ইমাম, কবীর চৌধুরীসহ দেশের প্রখ্যাত ২৪ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তাঁদের দ-দানের উদ্যোগ নিয়েছিল। জনগণের রায়ে যথাসময়ে ক্ষমতা হারানোর ফলে যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতার শত্রুদের পৃষ্ঠপোষক এই সরকার দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের শাস্তি দেয়ার কাজটি শেষ করে যেতে পারেনি।
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তাই অপরাধ অনুষ্ঠানের বিয়াল্লিশ বছর পরে হলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের শুধু বিচার শুরু হওয়া নয়, প্রথম দ-াদেশটি ঘোষিত হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি সোমবার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই প্রথম রায়টি ঘোষণা করেছে। ফরিদপুরের দুর্ধর্ষ রাজাকার এবং ঘাতক আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে এই মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। তার বিচার শুরু হওয়ার সময় থেকেই সে পলাতক। এই পলায়ন তার অপরাধের আরও বড় স্বীকৃতি। অপরাধী না হলে সে পালাত না। মাথা উঁচু করে বিচারের মোকাবেলা করত।
আমি নিজে মৃত্যুদ-দানের বিরোধী। কিন্তু মনীষী রাসেলের মন্তব্য উদ্ধৃত করেই বলতে চাই, মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ করার জন্য দায়ী এই নরপশুর জন্য মৃদ্যুদ- খুবই লঘু শাস্তি। তবু এই শাস্তির কথা শুনে লন্ডনেও বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যাপক উল্লাস দেখা গেছে। এক তরুণ টেলিফোনে কবি নজরুলের একটি বিখ্যাত কবিতা আবৃত্তি করে আমাকে শুনিয়েছেন। যার প্রথম লাইন হলোÑ ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’
ভারতে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গড্সেকে বিচারে প্রাণদ- দেয়া হয়েছিল। গড্সে বাংলাদেশের গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীদের মতো গণহত্যা, গণনির্যাতনে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ ছিল না। সে একজনমাত্র মহান নেতাকে রাজনৈতিক ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হত্যা করেছে। সেই নেতা আবার অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এই নীতিই ছিল তঁঁাঁর জীবনমন্ত্র।
নাথুরামের প্রাণদ-াদেশ ঘোষিত হলে এক গান্ধীভক্ত প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর কাছে আবেদন জানিয়েছিল, ‘গড্সেকে যেন প্রাণদ- না দিয়ে অন্য কোন দ- দেয়া হয়। কারণ প্রাণদ- গান্ধীজীর অহিংসা নীতির বিরোধী। গান্ধী যদি প্রাণে বেঁচে যেতেন তাহলে নাথুরাম গড্সেকে ক্ষমা করতেন, তাকে প্রাণদ- দিতেন না।’ নেহরু তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘গান্ধী শুধু একজন ব্যক্তিবিশেষ ছিলেন না। ছিলেন ভারতআত্মা। তঁাঁকে হত্যা করে গড্সে ভারতআত্মাকে হত্যাচেষ্টার জন্য দায়ী। তাকে ক্ষমা করা হবে ভারতবাসীর জন্য চিরকালের কলঙ্ক।’ জওয়াহেরলালের শেষ কথা, ‘গান্ধীজী মহাত্মা ছিলেন। আমি মহাত্মা নই। সারা ভারতের মানুষ আমার দিকে চেয়ে আছে অহিংসা ও মানবতার এই জঘন্য শত্রুকে আমি কি শাস্তি দেই তা দেখার জন্য।’
নেহরু অত্যুক্তি করেননি। দলমত নির্বিশেষে ভারতের সব মানুষের তখন দাবি ছিল, নাথুরাম গড্সের ফাঁসি হোক। তার জন্য কোন ক্ষমা নয়। এমনকি গান্ধী-রাজনীতির বিরোধী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (অবিভক্ত) মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতার সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম দেয়া হয়েছিল, ‘বজ্রের আওয়াজ থেকে ধ্বনি কেড়ে নেহরু বলো, মহাত্মাজীর হত্যাকারীর ক্ষমা নেই।’
বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে মানবতার জঘন্যতম শত্রুদের বিচার ও শাস্তির কোন প্রকার ব্যবস্থা না করে ৪০ বছর তাদের দেশে এবং সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর তাদের পালের গোদাদের অনেকে বিদেশে পালিয়ে গেলে বাংলাদেশের সামরিক শাসকরাই তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছে। সামরিক শাসকদের দ্বারা সেনাছাউনিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক দলটি মানবতার এই শত্রুদের দেশের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে; এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেছে। আমার তো ধারণা, এই অপরাধের জন্য সামরিক শাসকদের বিচার হওয়া উচিত। তাদের কেউ যদি মারা গিয়েও থাকেন, তাহলে ব্রিটেনে ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর কবর থেকে তার দেহ তুলে যেমন ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, এই অপরাধীদের সেই ধরনের শাস্তি পাওয়া উচিত।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদ-াদেশ ঘোষিত হওয়ায় আজ গোটা দেশবাসী এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছে যে, পালের গোদা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী প্রমুখ অভিযুক্ত মানবতার শত্রুরাও ন্যায়বিচার ও দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর দ- এড়াতে পারবে না। এই দ- দেয়া না হলে জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে না। স্বাধীনতাযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদ সেনা, বুদ্ধিজীবী, নারী ও শিশুর আত্মা শান্তি পাবে না।
এই মানবতার শত্রুদের আশা ছিল ৪০ বছরে তাদের অপরাধের প্রমাণগুলো লুপ্ত করে দেয়া যাবে। নিজেদের নির্দোষ এবং ধর্মের নিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরা যাবে। বিএনপির আশ্রয়ে এবং বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দল ও জঙ্গী সংগঠনগুলোর সহায়তায় তারা বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করে দিতে পারবে।
মধ্যপ্রাচ্যের একশ্রেণীর মুসলিম দেশের দেদার অর্থে বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়ে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে রাখতে পারবে এবং দেশময় আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে এমন ভীতি সৃষ্টি করবে এবং সৌদি আরব, তুরস্কের মতো দেশগুলোর দ্বারা এমন চাপ সৃষ্টি করবে যে, হাসিনা সরকার তাদের বিচার শুরু করলেও তা শেষ করার এবং তাদের দ- দেয়ার সাহস করবে না। বিচারকরা বিচার শেষ করা ও রায়দানে ভয় পাবে।
জামায়াতের এই তৎপরতার একটিমাত্র সাফল্য এই যে, তারা এই বিচার বানচাল করার জন্য একমাত্র বিএনপির সাহায্য ও সমর্থন আদায় করতে পেরেছে; কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের দাবিতে অনড় ও ঐক্যবদ্ধ দেশবাসীর মধ্যে সামান্য চিড়ও ধরাতে পারেনি। ফলে এই বিচার চালিয়ে যেতে জনসমর্থনের বলেই হাসিনা সরকার সাহসী হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনালও তাদের প্রথম রায় ঘোষণায় ভয়ের পরিচয় দেখায়নি।
মানবতার শত্রুদের শেষ ভরসা ছিল, প্রচারযুদ্ধে তারা সফল হবে। বিচারের প্রক্রিয়া ধীরগতিতে শুরু হওয়ায় তারা দামামা বাজাচ্ছিল। এই সরকার তাদের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদে বিচার কাজ শেষ করতে পারবে না অথবা শেষ করতে চায় না। খালেদা জিয়া তো তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় প্রচার শুরু করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার তলে তলে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করার চেষ্টা করছে।
বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডাদেশের রায়টি এই মিথ্যা প্রচারের ধূম্রজাল ছিন্ন করেছে। দেশবাসীর মনে এই প্রত্যয়টি ফিরে এসেছে যে, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাদের বর্তমান মেয়াদেই শেষ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একজনের বিচার ও শাস্তির আদেশ ঘোষিত হয়েছে। অন্যান্য পালের গোদারও হবে। সরকারের এই মেয়াদেই দ-াদেশগুলো কার্যকর না হলেও পরবর্তী মেয়াদে হবেই। অন্য কোন সরকার ক্ষমতায় এলেও এই দ-াদেশ তারা বাতিল করতে পারবে না। দেশের মানুষই তা রুখে দাঁড়াবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মৃত্যুদ-াদেশও বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় এসে খ-াতে পারেনি, নানা কলাকৌশলে তা কার্যকর করা বিলম্বিত করতে পেরেছিল মাত্র।
বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনালের রায় একটি ঐতিহাসিক রায়। এই রায়ের ফলে অন্যান্য রায় প্রদানও দ্রুততর হবে এবং জাতির সার্বিক কলঙ্কমুক্তির দিনটি আর বেশি দূরে নয় বলেই দেশবাসীর মনে প্রত্যয় সৃষ্টি হবে।

লন্ডন, ২২ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৩

No comments

Powered by Blogger.