ডিএনএ-বৃত্তান্ত কারও সঙ্গেই মিলছে না by কামরুল হাসান

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো নমুনা থেকে দুই ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ-বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে। তবে ওই দুই ব্যক্তির কোনো হদিস এখনো পায়নি র্যা ব।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত যাঁরা সন্দেহভাজন, তাঁদের কারও সঙ্গে এ ডিএনএ নমুনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে প্রায় এক বছর হলেও বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্ত নিয়ে এখনো অন্ধকারে আছে র্যা ব। বর্তমানে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্বে আছে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব)।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যা বের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশ থেকে পাওয়া ডিএনএ-বৃত্তান্তগুলো ধরে সন্দেহভাজনদের খুঁজে বের করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। অপরাধীদের খুঁজে বের করতে কত দিন সময় লাগতে পারে, জানতে চাইলে র্যা ব কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত পর্যায়ে এটা বলা যায় না।
র্যা ব সূত্র জানায়, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ১৩ জনের ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে পাঠানো ছয়জনের নমুনায় কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে আরও সাতজনের নমুনা পাঠানো হয়। গত সপ্তাহে র্যা ব কর্মকর্তার কাছে ই-মেইলে সে পরীক্ষার ফলাফল পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত নমুনার সঙ্গে কারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নির্দেশ করে। হাতের ছাপ, চুল, কফ, থুতু, রক্তসহ শরীরের যেকোনো উপাদান থেকেই ডিএনএ-বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। ডিএনএ থেকে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র্যা বের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত একজনকেও এখন পর্যন্ত তাঁরা শনাক্ত করতে পারেননি। যেসব ধারণা নিয়ে তাঁরা তদন্ত শুরু করেছিলেন, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন কী করবেন, তা-ও বুঝে উঠতে পারছেন না।
গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসা থেকে সাগর ও রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই হত্যাকাণ্ডের দিনই সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুনিদের গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় গত বছরের ১৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ আদালতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে। পরে উচ্চ আদালত র্যা বকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, র্যা বের পাঁচ সদস্যের তদন্ত দল এ মামলার তদন্ত তদারক করছে। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর দলটি গত ২৬ এপ্রিল ভিসেরা আলামতের জন্য তাঁদের লাশ আবার কবর থেকে তোলে। কিন্তু ভিসেরা পরীক্ষায় তাঁদের শরীরে বিষক্রিয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এরপর ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি সবাইকে চমকে দেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এঁরা হলেন: রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী পলাশ রুদ্র পাল ও নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। কিন্তু এঁদের প্রথম পাঁচজনই গত আগস্টে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যা ব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হন। মন্ত্রী বলেন, এঁরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এঁদের সঙ্গে বাসার দারোয়ান হুমায়ুন ওরফে এনামুলকেও অভিযুক্ত করা হয়। পলাতক এনামুলকে ধরতে সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ওই সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অপরাধের আলামত আমরা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করেছি, যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি। তারা পরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধীদের ডিএনএ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এর ভিত্তিতেই যেসব অপরাধীর নাম বললাম কিংবা এর বাইরে যদি কোনো ভিন্ন অপরাধী আমাদের তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়, তাদের ডিএনএ বিচার-বিশ্লেষণ করে আমরা অকাট্যভাবে আদালতে নিয়ে যেতে সমর্থ হব।’
গতকাল রাতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ‘ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার বিষয়টি আমি শুনেছি। দু-একদিনের মধ্যে এ নিয়ে র্যা বের সঙ্গে বসব।’
র্যা ব কর্মকর্তারা জানান, সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা ওই সাতজনের বিরুদ্ধে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি। এঁরা সবাই এখন কারাগারে।
র্যা বের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যার কারণ বা ঘটনা নির্দেশ করে—এমন ন্যূনতম সূত্রটিও তাঁদের হাতে নেই। এখন পর্যন্ত র্যা ব এ ঘটনায় ১১৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কিছুই মেলেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, তা শুধুই চমক।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করছেন সাংবাদিকেরা। একাধিক মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও সুষ্ঠু বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সর্বশেষ দেওয়া সময়সীমা অনুসারে ১৯ জানুয়ারির মধ্যে ঘাতকদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা না হলে ২০ জানুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিকদের মহাসমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে। সেখান থেকে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.