মধ্যপ্রাচ্য-শাসক পরিবর্তনই যথেষ্ট নয় by নাফিজ মোসাদ্দেক আহমেদ

 স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নাগরিক অধিকার, বিশেষত নারী অধিকার হচ্ছে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপায়, যার মাধ্যমে এ অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব। এখানকার অর্থনীতিকেও এজন্য বহুমুখী করতে হবে।
এটা এখন স্পষ্ট, এ অঞ্চলের যেসব সরকার উলি্লখিত সংস্কার সাধন করতে ব্যর্থ হবে, তারা ক্ষমতায়
থাকতে পারবে না


আর্থিক অনটন ও অসাম্যের সঙ্গে রাজনৈতিক নির্যাতন মিলে মিসর ও তিউনিসিয়ায় জনগণকে বিপ্লবে নামিয়েছে। এরপর নিশ্চিতভাবেই আশা করা হবে যে, এসব দেশের নতুন সরকারগুলো জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের দিকে নজর দেবে। কিন্তু কেবল সরকার পরিবর্তন করেই এসব দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা দূর হয়ে যাবে এটা আশা করা বাতুলতা মাত্র। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি নিঃশেষ হতে থাকাজনিত প্রতিক্রিয়ায় এ অঞ্চলে ত্রিমাত্রিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। এই অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৩ শতাংশের বাস, অথচ এখানে নবায়নযোগ্য সুপেয় পানির রয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। পানি দুষ্প্রাপ্য বিশ্বের এমন ১৫টি দেশের মধ্যে ১৩টি রয়েছে এ অঞ্চলে। দেশগুলো হচ্ছে আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, জর্ডান, কাতার, সৌদি আরব, ইয়েমেন, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। আটটি দেশের বছরে জনপ্রতি পানি প্রাপ্যতার পরিমাণ ২৫০ কিউবিক মিটার। এ অঞ্চলের মাত্র চারটি দেশ ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের রয়েছে পর্যাপ্ত সুপেয় পানি।
যদিও এখন জন্মহার কমছে, এরপরও এখনকার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বয়স ১৫ বছরের মধ্যে। নারীদের বিপুলসংখ্যক উৎপাদনশীল বয়সে পেঁৗছেছে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যের জনসংখ্যা ১৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আর সাব-সাহারা অঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে একই সময়ে ৮১ শতাংশ। এর ফলে এ এলাকায় তরুণ জনসংখ্যা অভাবনীয় পর্যায়ে বিস্তৃত হবে। ২০০৫ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক মূল্যায়ন রিপোর্টে দেখা যায়_ জনসংখ্যার ক্ষেত্রে এই প্রবৃদ্ধি পানির প্রাপ্যতা অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। এতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘর্ষ বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে; যেমন_ তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে, জর্ডান, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে, মিসর, সুদান ও ইথিওপিয়া এবং সৌদি আরব ও এর প্রতিবেশী দেশ কাতার, বাহরাইন ও জর্ডানের মধ্যকার উত্তেজনা উল্লেখযোগ্য। পানির প্রাপ্যতা অর্ধেকে নেমে এলে এসব দেশের মধ্যকার উত্তেজনা প্রকাশ্য সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। এদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে নগরায়ন ও উচ্চতর মাথাপিছু আয় এ অঞ্চলের দেশগুলোর পানির চাহিদাকে বৃদ্ধি করবে। উন্নয়নের ফলে মানুষের স্থানান্তর গমন বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় জাতিগত উত্তেজনাও বৃদ্ধি পাবে।
হাইড্রোকার্বন জ্বালানিশূন্যতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা তার ২০১০ সালের রিপোর্টে বলেছে, ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি উত্তোলনের পরিমাণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পেঁৗছার পর এখন নিম্নগামী। বিশ্বে জ্বালানি উৎপাদন নানাভাবে বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও চাহিদা ও জোগানের মধ্যে পার্থক্যটা বেড়ে চলেছে সেই ২০০৫ সাল থেকেই। আণবিক শক্তি কমিশন বলেছে, এই বর্ধিত জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য অবশ্যই অপ্রচলিত তেল ও গ্যাস মজুদ থেকে আহরণের ওপর জোর দেওয়া হবে, যার অর্থ দাঁড়াবে বৃহত্তর পরিবেশগত সমস্যা ও উত্তোলন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি বড় তেল উৎপাদনকারী দেশের ৭৪ হাজার কোটি ব্যারেল (জিবি) জ্বালানি তেল মজুদ থাকার কথা। কিন্তু অ্যাবরডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এসব দেশের মোট মজুদের পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি ব্যারেলের বেশি হবে না। এর অর্থ এই নয় যে, সস্তা তেলের জমানা একদম শেষ হয়ে গেছে। তবে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ তেল উত্তোলনকারী দেশগুলো যদি যেমনটা ধারণা করা হচ্ছে, সেভাবে ভূতাত্তি্বক সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে ২০২০ সাল বা ২০১৫ সালে এখনকার তেল উৎপাদনের পরিমাণ হবে অনুল্লেখ্য। এর অর্থ হবে, এ গুরুত্বপূর্ণ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তখন বিরাট আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে এবং এ ক্ষতির সঙ্গে বিদ্যমান পানি সংকট, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি বহুমাত্রিক সংকটের সম্মুখীন হবে। তবে একেবারে বাজে অবস্থা যে এড়ানো যাবে না, তা কিন্তু নয়। আগত পরিস্থিতির উপযোগী নীতি-কৌশল এখনই নিতে পারলে এ সংকট এড়ানো যায়। সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ উদ্যোগের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে পানি ব্যবহার হ্রাস করা সম্ভব এবং দক্ষতাও বাড়ানো সম্ভব। তবে হাইড্রোকার্বনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা ত্যাগ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নাগরিক অধিকার, বিশেষত নারী অধিকার হচ্ছে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপায়, যার মাধ্যমে এ অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব। এখানকার অর্থনীতিকেও এজন্য বহুমুখী করতে হবে। এটা এখন স্পষ্ট, এ অঞ্চলের যেসব সরকার উলি্লখিত সংস্কার সাধন করতে ব্যর্থ হবে, তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।

নাফিজ মোসাদ্দেক আহমেদ :লন্ডনের পলিসি রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক
খালিজ টাইমস থেকে ভাষান্তরিত
 

No comments

Powered by Blogger.