বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ ব্যারিস্টার এম. by আমীর-উল ইসলাম

(শেষাংশ) তার প্রথম অনুচ্ছেদেই জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার আন্তজাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। তারই সাথে একাত্মতার ভিত্তিতে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।
জাতিসংঘ সনদ ও সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় উলি্লখিত মানবিক মূল্যবোধ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় স্থান লাভ করে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার মূল অঙ্গীকার। এই ঘোষণা বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে- যা নিম্নরূপ :
"আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধিলাভ করিতে পারি এবং মানবজতির প্রগতিশীল আশা আকাক্মখার সহিত সঙ্গতি রা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার েেত্র পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অুণ্ন রাখা এবং ইহার রণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।"
বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটক রেখেও যখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে পরিচালিত মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে পারল না, তখন জেলের মধ্যেই শুরু হলো বিচার নামক প্রহসন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলো তাঁর বিরুদ্ধে। মৃতু্যদণ্ড দেবার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা চেয়ে চাপ সৃষ্টি হলো ইয়াহিয়া সরকারের ওপর। ফলে মৃতু্যদণ্ড দেবার প্রস্তুতি স্থগিত রাখা হলো। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য যখন নিশ্চত হতে যাচ্ছে তখন শুরু হয় নতুন নতুন অপকৌশল আর ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এ দেশকে সর্বব্যাপী নেতৃত্বহীন, আদর্শচু্যত ও বিভ্রান্ত করা ছিল এই ষড়যন্ত্রের মূল ল্য। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যখন সুনিশ্চিত তখন বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে এ দেশকে তারা করতে চেয়েছিল সকল েেত্র মেধাশূন্য, পঙ্গু ও নেতৃত্বহীন। অধ্যাপক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এক দীর্ঘ হত্যা তালিকায়। বুদ্ধিজীবীদের এই হত্যাকাণ্ড হিটলারের ইহুদী নিধন ও গ্যাস চেম্বারে গণহত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। ঢাকার মোহাম্মদপুর- মিরপুরসহ প্রতিটি জেলা শহরে তৈরি হয়েছিল এক একটি বধ্যভূমি।
মুক্তি যুদ্ধের বিজয় যখন নিশ্চিত তখন বাঙালী উর্ধতন সরকারী কর্মচারীদের নিধন করার জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছিল তৎকালীন গবর্নর হাউজে। ইতোমধ্যে খবর পেঁঁৗছে যায় যুদ্ধকালীন সরকারের কাছে। আকাশ যুদ্ধ শুরু হয়। তৎকালীন গবর্নর হাউজে স্ট্র্যাপিং করা হয়। গবর্নর হাউস থেকে গবর্নর মালিক বেরিয়ে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (অধুনা ঢাকা শেরাটন) আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ফলে সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তান সামরিক শক্তি যখন বুঝতে পারল যে তারা নিশ্চিতভাবে পরাজিত হতে যাচ্ছে, তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নামে গুপ্তচরের অনুপ্রবেশ ঘটানো ছিল পাকিস্তানী সামরিক কৌশলেরই আরেকটি দিক। এমন অনুপ্রবেশের মাধ্যমেই এই নতুন ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। দেশ স্বাধীন হবার পরও পাকিস্তান সেনা বাহিনীর গুপ্তচর সংস্থা তাদের কাজ অব্যাহত রাখে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে মুক্তিযুদ্ধের ল্য, স্মৃতি ও ইতিহাসকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার এক হীন ষড়যন্ত্রের শিকার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাঁর পরিবারবর্গ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ।
শেখ মুজিবের যে মৃতু্যদণ্ড আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপের কারণে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান কারাগারে কার্যকর করতে পারেনি, তা তার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর নেতৃত্বে কার্যকর হলো স্বাধীন বাংলাদেশে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ্দৌলাকে হত্যা করতে কাইভের চক্রান্তে কোম্পানির গুপ্তচররা যেমন ব্যাবহার করেছিল মীর জাফর, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, মীরন ও মোহাম্মদী বেগকে, তেমনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করানো হলো বাংলার মাটিতে বাংলার বেইমানদের দ্বারা। ইতিহাসের কী করুণ পরিণতি, কী হৃদয়বিদারক পুনরাবৃত্তি!
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে, শিশু রাসেলসহ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাঁরা তখন বাস করছিলেন সপরিবারে তাঁদের সবাইকে হত্যা করা হলো। জনাব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা; বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন_ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে হত্যা এ সবই একই ষড়যন্ত্রের অংশ। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনে এটা ঐণভমডধঢণ অর্থাৎ এক প্রকার গণহত্যা হিসাবে চিহ্নিত। সে গণহত্যা থেমে থাকেনি। এমনি অপরাধ ঘটেছে যশোরের উদীচী শিল্পীদের হত্যায়, নিভর্ীক সাংবাদিকদের হত্যাকাণ্ডে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর জনসভায় উপস্থিত সকলের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রে কোটালীপাড়ায় বোমা পাতা, সাতীরার সার্কাসে, ময়মনসিংহ প্রোগৃহে বোমা হামলা, ২১ আগস্ট ২০০৪-এ শেখ হাসিনার জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা, আইভি রহমানসহ ২২ জন হত, এসএএমএস কিররিয়াকে হত্যা, শত শত নেতাকর্মীকে পঙ্গু, হত্যা, নির্যাতন। সেই সাথে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এসব নির্যাতনের আরেক রূপ। এমনিভাবে এদেশকে নেতৃত্বহীন, অপরদিকে স্বাধীনতার পরে সকল শক্তিকে বিভ্রান্ত, বিকল এবং ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের সা্য বহন করে। এর পূর্বর্েও নওগাঁয় শেখ হাসিনার গাড়িতে আক্রমণ, সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ওপর অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন, হামলা-মামলা, হত্যা নিপীড়নের স্টিম রোলার এই গভীর ষড়যন্ত্রেরই দৃষ্টান্ত। এসব অপরাধের কোন তদন্ত নেই। নেই কোন বিচার প্রক্রিয়া। ১ অক্টোবর ২০০১-এর নির্বাচনের পর থেকে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মীকে হত্যা, জখম ও মিথ্যা মামলা ও তাদের পরিবারের মা-শিশু, কিশোরীরা পর্যন্ত নির্যাতন, অশ্লীলতা ও আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। নাটোরের জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা মমতাজউদ্দিন, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল ইমাম প্রতিপকে হত্যা, পরিবারের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, বাড়ি/অফিস ভাংচুর, দোকান খামার লুট_ এ সবের সঠিক কোন তদন্ত বা বিচার হয়নি। অপরদিকে ৭০,০০০ সন্ত্রাসীর ওপর থেকে মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। শুরু হয়েছে দলীয়করণ। দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে জনজীবন অসহনীয়। প্রশাসনের সকল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত অথবা ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের সাথে প্রত্য-পরো সম্পর্কযুক্ত বা আত্মীয়তা থাকলে এই প্রজাতন্ত্র অথবা প্রশাসনের কোন চাকরিতে বহাল হওয়া বা বহাল থাকা যাবে না। ব্যাবসা-বাণিজ্য থেকে উচ্ছেদ অর্থাৎ পাকিস্তানীদের মতো স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পরে সকলকে বৈষম্যের শিকার বানানো হয় সেই জোট সরকারের আমলে। বিনা বিচারে আটক ও ৫৪ ধারায় গ্রেফতার, নির্যাতন পর্যবসিত হয় বিনাবিচারে নরহত্যা; ধর্মে, আইনে ও সংবিধানে যা নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে এই অপরাধে জড়িত করার ফলে এটা একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে রূপ নিয়েছিল।
এসব বাঙালী জাতির ইতিহাসের এক জঘন্য ও কলঙ্কময় অধ্যায়। আরও কলঙ্কময় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের যাতে বিচার না হতে পারে, আইনকে অবরোধ করবার জন্য তৈরি হয়েছিল ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ '৭৫। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে মতায় এলে সংসদে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হলো। রায়ে ফাঁসির আদেশ হলো। হাইকোর্ট বিভাগ রায় অনুমোদন করে বেশির ভাগ সাজা বহাল রাখল। অথচ আপীল বিভাগে সে রায়ের আপীল শুনানি নানা কৌশল ও অজুহাতে ঝুলিয়ে রাখার ফলে আইনের শাসন ছিল ভূলুণ্ঠিত। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নির্বাহী প্রধানের মতামত প্রাধান্য পাবার ফলে এক ব্যক্তির ইচ্ছায় বিচারপতি নিয়োগ, স্থায়ীকরণ, ১৬ জন অস্থায়ী বিচারপতি অপসারণের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধূলিসাত করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায়ে আওয়ামী লীগ মতায় আসার পর আপীল বিভাগে নতুন বিচারক নিয়োগ করে বহু বছর থেকে ঝুলে থাকা মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ায় জাতি কিছুটা কলঙ্কমুক্ত। খুব শীঘ্রই এই চূড়ান্ত রায় বাস্তবায়িত হবে_ এই প্রত্যাশা ও প্রতীায় রয়েছে বাংলার জনগণ।
জাতিসত্তার গোড়ার কথা হলো জাতিগতভাবে মৌলিক মূল্যবোধের সৃষ্টি এবং অবিচলভাবে নিষ্ঠার সাথে সে মূল্যবোধের লালন। এমনি মৌলিক মূল্যবোধের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্র ও তার সংবিধান, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। আইনের শাসন ও সকললের জন্য সুবিচার নিশ্চিত লাভের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন হবে_ এমনটি আশা নিয়ে জনগণ বুক বেঁধে অপোরত।
কিন্তু জাতিসত্তার উষালগ্নেই আমাদের মৌলিক এই আত্মচেতনাবোধে হানা হয়েছে চরম আঘাত। জাতির জনকের হত্যাকারীদের সাজা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অতিসত্বর সংবিধান ও আইনের শাসনের উত্তরণ ঘটবে। পুনর্প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপটির এমন প্রত্যশায় ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিজয়ের বেশে প্রত্যাবর্তন দিবস জনগণকে অমানিশা অতিক্রম করে আইনের শাসন পুনপর্্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পে আরও দৃঢ় শপথ গ্রহণের সময়।

No comments

Powered by Blogger.