'৭১-এর 'মুক্তি'র সব কপি '৭৫-এর পর পুলিশ গায়েব করে- মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র-৪১ by মুনতাসীর মামুন
'গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ' গ্রন্থে হাসিনা আহমেদ ১৯৭১ সালে মুজিবনগর ও মুক্তাঙ্গন থেকে প্রকাশিত ৬৪টি পত্রপত্রিকার একটি তালিকা করেছেন। এটি প্রায় সম্পূর্ণ।
সে তালিকায় কিছু পত্রপত্রিকার নাম স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়ে যেতে পারে। এখানে আলোচিত 'মুক্তি' সে রকম একটি পত্রিকা। হাসিনা অবশ্য তাঁর আলোচনায় দু'টি 'মুক্তির কথা' উলেস্নখ করেছেন। একটি ছিল মাসিক, অপরটি পাৰিক। আলোচিত মুক্তি ছিল সাপ্তাহিক।'মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র' প্রকাশিত হতে থাকলে প্রাক্তন এম-সি-এ খোন্দকার আবদুল মালেক (শহীদুলস্নাহ) [মুক্তাগাছা, মযমনসিংহ] আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান "তাঁর সম্পাদনায় আসাম রাজ্য সহায়ক সমিতির সহযোগিতায় ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে মুজিবনগর [আসলে গৌহাটি] থেকে 'সাপ্তাহিক মুক্তি' প্রথম প্রকাশিত হয়।" সম্পাদক হিসেবে তাঁর ছদ্মনাম ইবনে আদম ব্যবহৃত হয়। "পত্রিকাটিতে অধ্যাপক ড. সুধাময় দাস সহকারী সম্পাদক, প্রয়াত রমেন দত্ত বার্তা সম্পাদক ও মোজাম্মেল হক স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
উলেস্নখ্য, ১৯৭৫-এর ১২ ডিসেম্বর আমি গ্রেফতার হলে আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য অন্যান্য দলিল ও বইপত্রসহ 'মুক্তি'র সমসত্ম কপি পুলিশ কর্তৃক গায়েব করা হয়।" সম্প্রতি তিনি পত্রিকার মাত্র একটি সংখ্যা খুঁজে পেয়েছেন। [ ৬ সংখ্যা ১৫.১০. '৭১]
'মুক্তি'র শিরোনামের পাশে ছাপা হতো বঙ্গবন্ধুর ছবি ও বাণী। শিরোনামের নিচে লেখা ছিল 'বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সাপ্তাহিক মুখপত্র।' মূল ১৫ পয়সা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত অন্যান্য পত্রিকার মতোই ছিল এর আকৃতি ও প্রকৃতি। যেমন, ষষ্ঠ সংখ্যার শিরোনামগুলি ছিল_ 'পাকিসত্মানের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে', 'হানাদার বাহিনীতে অনত্মর্দ্বন্দ্ব ঃ আড়াই হাজার রাজাকারের দল ত্যাগ, 'সৈয়দ নজরম্নল ইসলামের ভাষণের বিবরণ', 'সামরিক প্রহরাধীন থেকেও কুখ্যাত মোনেম খাঁ খতম হলো' ইত্যাদি।
'আড়াই হাজার রাজাকারের দল ত্যাগে' জানানো হয়েছে, পত্রিকার এক সংবাদদাতা এক রাজাকারের সাৰাত নেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধে পরে যোগ দিতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী অনেক রাজাকার দলত্যাগ করেছে_ "এক প্রশ্নের উত্তরে জনৈক রাজাকার এই সংবাদদাতাকে জানান, এমন বহু রাজাকার আছেন, যাঁরা অতি গোপনে বিভিন্ন উপায়ে মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করে থাকেন।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে উক্ত রাজাকার জানান, 'দেশের যত চোর, ডাকাত, গু-া, বদমাশ ছিল তারাই এখন রাজাকার। আর সাময়িকভাবে জীবন বাঁচাবার তাগিদেও অনেকেই রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে।'
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, 'দেশের মানুষ ভয়ে আমাদের (রাজাকার) কিছু বলত না। কিন্তু তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠত একটা নিদারম্নণ ঘৃণা আর বিদ্বেষ।'
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে উক্ত রাজাকার আরও জানান, 'আমরা তো ভেবেছিলাম। চিরদিন আমাদেরকে বাংলাদেশ আর বাঙালীর শত্রম্ন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে ঘৃণিত জীবন নিয়ে বাঁচতে হবে কিন্তু মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার সুযোগ করে দেয়ায় কর্তৃপৰকে আমাদের আনত্মরিক ধন্যবাদ।"
এই সংখ্যায় দীর্ঘ এক সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে 'স্বাধীনতাই একমাত্র সমাধান' শিরোনামে। সেখান থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি_ বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে বিশ্বজনমত আজ সোচ্চার কণ্ঠে দাবি তুলছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রশ্নে যে মুসলিম দেশগুলো পাকিসত্মানের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রানত্ম হয়ে পাকিসত্মানকেই সমর্থন করছিল, সে সমসত্ম দেশগুলোতেও বাংলাদেশের পৰে দ্রম্নত জনমত গড়ে উঠছে। সুদানের পত্র-পত্রিকায় অনেক আগেই বাংলাদেশের পৰে মতামত প্রকাশ করেছিল। সংযুক্ত আরব সাধারণতন্ত্রের আধা সরকারী মুখপাত্র 'আল-আহরামে' সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি, ১৯৭০ সালের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ৰমতা হসত্মানত্মরের দাবি জানানো হয়েছে। 'আল-আহরামের' মনত্মব্য, কায়রোর সরকারী মহলেরই মনত্মব্যের পূর্বাভাস। কাতার আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। কাতারের আমির সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে 'বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী' বলে স্বীকার করেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে জনমত উপেৰা করে কয়েকটি দেশের শাসকগোষ্ঠী এখনও যে মারাত্মক খেলা খেলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তন্মধ্যে অন্যতম এবং বৃহৎ শক্তি। 'মার্কিন বিবেকের কণ্ঠস্বর' বলে সুপরিচিত সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি নিক্সন সরকারের স্বরূপ নগ্নভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। স্বার্থের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা যে কত নিচে নামতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তার প্রমাণ। এদের তোষামোদ করে কোন ফল হয় না। ন্যায়নীতি ও মানবতার বালাই বলতে এদের কাছে কিছুই নেই। 'মুগুর' নিয়ে দাঁড়াতে হয়। বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলতে হয়।"
No comments