চারা সঙ্কটে বিপর্যস্ত বোরো আবাদ ॥ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয়- তীব্র শৈত্যপ্রবাহে বেশিরভাগ বীজতলা নষ্ট, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে উপাদন খরচও বেড়ে গেছে by কাওসার রহমান

 চারা সঙ্কটে এবার বোরো আবাদের বিপর্যস্ত অবস্থা। তীব্র শৈত্যপ্রবাহে বেশিরভাগ বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চারার অভাবে কৃষক বোরো আবাদ করতে পারছেন না। তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।
ফলে কৃষক ধানের পরিবর্তে অন্য ফসলে চলে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, শৈত্যপ্রবাহের ধাক্কা সামলে মাঠে নেমে কৃষক বোরো চারার সঙ্কটে পড়েছে। প্রচ- শৈত্যপ্রবাহে কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে এবার বেশিরভাগ বোরোর বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে সারাদেশেই বোরো চারার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে বোরো চারা সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে এ বছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
গত ৪৫ বছরের মধ্যে এবার বাংলাদেশে তীব্র শীত অনুভূত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা তিন ডিগ্রীতে নেমে এসেছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো দেশের সব এলাকাতেই তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রীর নিচে নেমে গেছে। এতে মাঠে থাকা বোরো ধানের বীজতলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষক পলিথিন দিয়ে ঢেকে কিংবা কুয়াশার পানি সরিয়ে বীজতলা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতেও খুব একটা বেশি কাজ হয়নি। চলতি বছর দেশে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের জন্য কমপক্ষে তিন লাখ হেক্টর জমিতে বীজতলা করা হয়েছে। কিন্তু ওই বীজতলার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে এবার বোরো চাষ নিয়েই কৃষক দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন।
উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের চাষীরা বোরো আবাদের জন্য মাঠে নেমেই চারা সঙ্কটে পড়েছেন। হন্যে হয়ে খুঁজেও কোথাও বোরো চারা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথাও পাওয়া গেলেও দাম অসম্ভব চড়া। এক বিঘা জমির বীজ চারার দাম পড়ছে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এমনিতেই সেচ ও জমি চাষ খরচ বেড়ে গেছে। তার ওপর বোরো চারা সঙ্কটে কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তারা বোরো আবাদের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছে।
তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কারণে এবার সবচেয়ে বেশি বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। ওই এলাকায় তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি কমে গিয়েছিল। ফলে ওই অঞ্চলে বোরো চারা সঙ্কটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। তবে যে সকল কৃষক ম্যাজিক গ্রোথ তরল সার ব্যবহার করেছেন তাদের বীজতলা নষ্ট হয়নি। কারণ তীব্র শীতের কারণে বোরো চারা মাটি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেনি, ফলে তরল সার ব্যবহার করার কারণে চারা ফলিয়ারের মাধ্যমে খাবার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এতে বীজতলার চারা সুস্থ ছিল। তবে কৃষক বলছেন, শৈত্যপ্রবাহের পর যে পরিমাণ বীজতলা অক্ষত আছে তা দিয়ে ২৫ শতাংশ জমিও চাষ করা সম্ভব হবে না।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের কৃষক দিলখোস আলী মোবাইল ফোনে জানান, এখন উত্তরাঞ্চলে বোরোর ভরা মৌসুম। কিন্তু চারার অভাবে কৃষক বোরো আবাদ করতে পারছে না। শৈত্যপ্রবাহে নষ্ট হওয়ার পর যে চারা আছে তা দিয়ে ২৫ ভাগ বোরো জমিও আবাদ করা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘সব কৃষকেরই বীজতলা নষ্ট হয়েছে। ফলে কোথাও বীজ চারা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কৃষক বোরো আবাদ না করে অন্য ফসলে চলে যাচ্ছে।’
বিএডিসির কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরাঞ্চলে বোরোর বীজতলা এতটাই নষ্ট হয়েছে যে, এই এলাকায় এবার অতিরিক্ত ৪০০ টন বিআর ২৮ ধানের বীজ বিক্রি হয়েছে। নতুন করে বীজতলা তৈরি করে বোরো আবাদ করতে গিয়ে যেমন বিলম্ব হবে, তেমনি বিলম্বিত আবাদ থেকে ভাল ফলন পাওয়া যাবে না।
বীজতলা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিও কৃষককে চরম বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো আবাদের সব খরচই বেড়ে গেছে। জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর ও সেচ খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক কৃষক এবার বোরো আবাদ কমিয়ে দিয়েছে। এ সকল বোরো জমিতে তারা অন্য ফসল আবাদের চিন্তা করছে। এতে চলতি বছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আগে প্রতিলিটার ডিজেল কিনতে হতো ৬২ টাকায় এখন কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকায়। এতে ট্রাক্টরে জমি চাষ ও সেচের জন্য প্রায় দ্বিগুণ খরচ গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। গত চার বছরে ডিজেলের দাম আড়াই গুন ও ইউরিয়ার দাম তিন গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ কৃষক বাজারে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না। ফলে কৃষক এবার বোরো আবাদ না করে অন্য রবি শস্য আবাদের দিকে যাচ্ছে। গম, সরিষা, ছোলা, ডাল, সয়াবিন, মরিচ ও বাদাম প্রভৃতি ফসল আবাদের জন্য জমি প্রস্তুত করছে। এতে উৎপাদন খরচ কম হবে এবং লাভ বেশি হবে।
বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলায় কৃষক এখনও পুরোদমে বোরো আবাদে মাঠে নামেননি। শৈত্যপ্রবাহে বীজতলা নষ্ট হওয়ায় এবং ডিজেলের মুল্য বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা এখন বোরো আবাদ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন। ফলে এ বছর এ অঞ্চলে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ অঞ্চলে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা গত বছরের প্রকৃত আবাদের চেয়ে ১৫ হাজার হেক্টর কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু চাষীদের যে মতিগতি তাতে এই লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ বছর বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলায় তিন লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ লাখ টন। গত দুই বছর ধরে কৃষকরা ধান আবাদ করে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনছে। গত দু’বছরে চাষীদের প্রতি মৌসুমের ধানে বিঘাপ্রতি ৫/৬ হাজার টাকা করে লোকসান হয়েছে। এজন্য এ বছর বোরো আবাদ কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। যদিও সম্প্রতি বাজারে ধানের দাম আবার বেড়েছে। গত দেড় মাসে প্রতিমন ধানের দাম ৮০০ টাকার ওপর উঠে গেছে।
ধানে লোকসান হওয়ায় অনেক কৃষক ভুট্টা আবাদের দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কৃষকের বক্তব্য হলো- ধান আবাদ করে দীর্ঘদিন থেকে লোকসান দিয়ে আসছি, তাই এবার ধানের আবাদ কমিয়ে ভুট্টার আবাদ করেছি। ভুট্টায় লাভ না হলেও লোকসান গুনতে হয় না।
তাই স্থানীয় কৃষি কর্মীরা কৃষকদের উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করতে গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগে পরামর্শ দিচ্ছেন। গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার, নন-ইউরিয়ার বেশি ব্যবহার, লাইন সুইং, পার্সিংসহ সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে চাষ করতে বলছেন। তবে যেভাবে বার বার ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে তাতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তাই ধানের বাজারমূল্য সরকার না বাড়ালে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

No comments

Powered by Blogger.