হাঁটি হাঁটি পা পাদের নিয়ে by ডা. এটিএম রফিক উজ্জ্বল

আপনার বাচ্চা বড় হচ্ছে। এতদিন নিজেই বসতে পারত, এখন সে ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখছে। হাত ধরে হাঁটছে। হয়ত দু এক কদম হাঁটছে। আপনার বাচ্চার বয়স এখন এক বছর।
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন বস্তু ও ব্যক্তির সাথে তার পরিচিতি ঘটছে। সে প্রতিনিয়ত আছরে পড়ছে বস্তু থেকে বস্তুর দিকে। তার এটা চাই, তার ওটা চাই। চাই চাই চাই। সাধারণত ১ বছর থেকে ৩ বছর পর্যনত্ম বাচ্চাদেরকে আমরা গুটিগুটি হাঁটুয়া বা টডলার বলে থাকি। এসময় তার বিশেষ কিছু পরিবর্তন পরিলৰিত হয়। তার গড়নে, তার গঠনে, তার বচনে, তার সবৰেত্রে। নিত্যনতুন অনুসন্ধান তাকে স্বাভাবিক বিবর্তনের পথে ঠেলে দেয়। ১ বছরে সে হাত ধরে হাঁটতে শেখে, ১৫ মাস বয়সে সে একাই হাঁটবে। এ বয়সে সে নিচু হয়ে কোন জিনিস তুলতে চাইবে।
৩ বছরে সে তিন চাকার সাইকেল চালাতে পারবে। এ তো গেল তার হাঁটার কথা। এবার অন্যান্য সূক্ষ্ম হাতের ও মননের কাজগুলোও ধারাবাহিকভাবে গড়ে উঠবে। সে আঙ্গুলের মাথায় একটি পুঁথি শক্ত করে ধরতে পারবে ১ বছরে। আপনি যদি বলেন ওটা দাও, তাহলে সে তার হাতের বস্তুটি আপনাকে দিয়ে দেবে। ১৫ মাস বয়সে সে দুটো ছোট বস্নক একটার উপরে আর একটি রাখতে শিখবে।
১৮ মাস বয়সে আপনার সোনামণি পেন্সিল নিয়ে কাগজের ওপর অনর্থক অাঁকতে শিখবে। ৩ বছরে সে একটা গোল বৃত্ত অাঁকবে, আপনার ছোট শিশুটির প্রথম বচন হয়ত ছিল মা এক বছরে। তারপর হয়ত বাবা, দাদা ও কাকা। ১৮ মাস বয়সে তার ১০টির বেশি শব্দসম্ভার থাকবে। ২ বছর বয়সে তার ৫০টির মতন শব্দ জানা থাকবে। বুঝবে তারও বেশি। ও বয়সে সে দু শব্দের সমন্বয়ে বাক্য গঠন করতে শিখবে। 'বাবা যাও', 'মা এসো'। তারপর ৩ বছরে পুরো বাক্য। সে বচন আর থামবার নয়। ২ বছরেই সে 'খুশি', 'সুখী', 'ভাল' বিশেষণগুলোর অর্থ বুঝতে শিখবে।
সামাজিক প্রাণী হিসেবেও কিন্তু সমান তালে এগিয়ে চলছে সে। সেই কবে ৯ মাস বয়সেই সে 'টা টা' দিতে শিখেছে। ১৫ মাসে এসে বড় আপু বা ভাইয়ার মতন একা একা কাপ থেকে খেতে চাইবে। ১৮ মাসে তো সে একা একা চামচ ব্যবহার করে বড়দের মতন খেতে শিখবে। এখন সে পাটিতে বসে। আড়াই বছর বয়সে আসত্মে আসত্মে অনত্মত দিনে-দুপুরে সে কমোডে বসবে। ৩ বছর বয়সে সে নিজের পোশাক নিজেই পরতে শিখে। শুধু বোতাম লাগাতে হয়ত তখনও পারবে না।
সব বাচ্চাই যে সমান গতিতে চলবে তা নয়, বরং বাচ্চা থেকে বাচ্চার কিছু ভিন্নতা থাকবে। সব বাচ্চা একই সময়ে হাঁটতে শিখবে, বসতে শিখবে তা নয়। আবার দেখা গেল, হাঁটতে অন্য বাচ্চার চেয়ে দেরিতে শিখলো কিন্তু বুদ্ধির বিকাশে সে হয়ত আরও এগিয়ে।
তবে এমন যদি হয়, ১২ মাসেও সে বসতে শিখছে না, আঙ্গুল দিয়ে পুঁথি ধরতে শিখছে না। এমন যদি হয়, ১৮ মাসেও একা হাঁটতে পারছে না ৬টির বেশি শব্দ জানা নেই কিংবা মুখ দিয়ে অনবরত লালা বের হচ্ছে, আড়াই বছরেও ২ শব্দের সমন্বয়ে বাক্য গঠন করতে পারছে না তাহলে চিনত্মার বিষয়।
কিন্তু গুটি গুটি হাঁটুয়াদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা খাদ্য গ্রহণের বেলায়। এরা খেয়ালি হয়। কখনও অনেক খেল, কোন বেলায় কিছুই খেল না। এ নিয়ে তো মায়ের উদ্বেগের শেষ নেই। 'আমার বাচ্চা কিছুই খায় না।' খাওয়া নিয়ে তো হুলসত্মূল কা-। টিভি ছেড়ে পাখি দেখিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর পিছনে ছুটে শেষে 'দুধ কলাভাত কাকে খায়।' তাদের সম্পর্কে আপনার মনোভাব মনোভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদেরকে জোর করে খাওয়ানো যাবে না। তাকে আপনার টেবিলে নিয়ে বসুন। ভাত-মাছ আপনাদের খাদ্য মাখিয়ে দিন। কিছু খেল, কিছু নষ্ট করল, তবুও তাকে তা করতে দিন। এ বয়সে খাদ্য তালিকা মোটামুটি বড়দের মতন প্রায়। কারণ এসময় শিশুর ফ্যাটসমৃদ্ধ খাদ্য তালিকা থেকে সরে অন্য উপাদানসমৃদ্ধ খাদ্য তালিকা অনুসরণ করম্নন। কারণ এ সময়ে তারা ৩৫ শতাংশ শক্তি শুধু ফ্যাট থেকে পাবে। গুটি গুটি এই ছোট্ট শিশুরা বলতে গেলে সবই খাবে। তাদেরকে ৩ বেলা মূলত মূল খাদ্য দিতে হবে। ৩ বেলা ভাত, মাছ, মাংস, তরিতরকারি ডাল কিংবা ডালে-চালে খিচুড়ি দিতে পারেন। মধ্যবর্তী ২টি নাসত্মা_সকাল ও দুপুরের মাঝখানে ১টি এবং বিকালে ১টি। আর অনত্মত দুইবেলা ফুলক্রিম দুধ খাবে হাফ লিটারের মতন প্রতিদিন। এসময়ে আয়রনসমৃদ্ধ খাদ্যগুলো বেশি দিতে হবে। কারণ এ সময়ে রক্তশূন্যতা হয় বেশ। এর অন্যতম কারণ প্রতিবেলা শুধু দুধ খায়, অন্য খাদ্য খায় না বাচ্চারা।
যদি তাদের গঠন ভাল হয়, তাহলে মাখন তোলা দুধ এবং দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য ২ বছর থেকে দিতে শুরম্ন করম্নন। খাদ্যে অাঁশ জাতীয় খাদ্য অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। আর দাঁতের ৰয়রোধ করতে মিষ্টি জুস ফিডারে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে ১ বছর বয়স থেকে। বোতলের নিপ্ল থেকে মিষ্টি জুস তার দাঁতের ৰয়কে বাড়িয়ে দেবে।
গুটি গুটি হাঁটুয়াদের ছোটখাটো থেকে বড় বড় দুর্ঘটনার ৰেত্রে আপনাকে কিন্তু সচেতন হতে হবে। তাকে রান্না ঘরে যেতে দেয়া যাবে না। তাকে একা বাথরম্নমে যেতে দেয়া যাবে না। সে খাটের থেকে নামতে যেয়ে পড়তে পারে। সে সোফায় আঘাত পেতে পারে। সে ঘরে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে কাঁদতে থাকবে_খুলতে পারবে না। সে গ্রিল খোলা থাকলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে চাইবে এবং মারাত্মক আঘাত পেতে পারে। এসব ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আর শীতকালে সচেতন হতে হবে_পানি গরম করে নিয়ে যাওয়ার সময় হুড়মুড় করে সে আসায় তাদের ওপর গরম পানি পড়লে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
একটি টডলার বাচ্চা মোটামুটি ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ঘুমাবে। ঘুমের অভ্যাস এক এক বাচ্চার এক এক রকমের।

রাগ-ৰোভ বা টেম্পার ট্যানট্রামস
বিশেষ করে তৃতীয় বছরে রাগ-ৰোভের বহিঃপ্রকাশ বেশি ঘটে। অল্পতে রেগে যায়, কান্নায় অস্থির হয়ে যায় কিংবা হাত-পা ছুড়তে থাকে। তাদের জানা নেই, কোনটি সামজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যবহার, আর কোনটি নয়। তাদেরকে সে শিৰা আসত্মে আসত্মে দিতে হবে।
সবচেয়ে ভাল উপায় হলো এরকম ৰোভের ও জেদের পরিবেশ যাতে না হয় সে ব্যাপারে বাবা-মায়ের সচেতন হওয়া। তাই বলে এই নয় যে, সে যে অন্যায় আবদার করবে সেটাই আপনি দিতে বা করতে বাধ্য। বরং সে যাতে করে বেশি কানত্ম না হয়ে ওঠে, সে যাতে করে বেশি ৰুধার্ত না হয়ে ওঠে, সচেতন থাকুন। একটা বিষয় খুব পরিষ্কার করে তাদেরকে জানিয়ে দিতে হবে, কি করা যাবে, কি করা যাবে না। জোর করে নয় বরং শানত্ম-সি্নগ্ধ পরিবেশে তাকে তা করতে শেখাতে হবে। তারপরেও আপনার বাচ্চা রাগ-ৰোভে ফেটে পড়লে তাকে একা একা বেড রম্নমে রেখে দিন। সময়ৰোপণ করম্নন। আপনার রাগটা কমল, আর তারটাও। তারপর সে নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে। স্বাভাবিক স্বাস্থ্য রৰার নিয়মগুলো যেমন হাত ধোয়া, পটে বসা এবং পরবর্তীতে কমোডে বসা। ৩ বছর বয়স থেকে প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করতে শেখান।

ছোট বাচ্চারা খুব মজার। সদা ব্যসত্ম জীবনে ভরপুর। তাদের এনার্জির শেষ নেই। অনুসন্ধানের শেষ নেই। তাকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দিন। গড়ে উঠতে দিন। শুধু আপনার যত্ন ও ভালবাসার যেন কমতি না হয়। মনে রাখবেন, 'একটু খানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে।'

রেজিস্ট্রার, শিশু বিভাগু, হলিফ্যামিলি হাসপাতাল, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.