আনস্ট্যাবল হাঁটু বা জোড়া ছুটে যাওয়ার প্রবণতা ও করণীয়

ডাক্তার সাহেব, অনেক দিন আগে হাঁটুতে আঘাত পেয়েছি এবং এখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে অসুবিধা হয় ও উঁচু-নিচু জায়গায় হাঁটলে মনে হয় হাঁটু ছুটে যাচ্ছে বা বেঁকে যাচ্ছে।"
রোগীদের মুখ থেকে প্রায়ই এই ধরনের কথা শুনতে পাই। কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারে এই সমস্যার যন্ত্রণা। হাঁটু একটি জটিল জোড়া যেখানে শুধু দুই ধরনের মুভমেন্ট হয়, সামনে ও পিছনের দিকে। হাঁটুর জোড়া উপরের দিক থেকে ফিমার ও প্যাটলা বা নী ক্যাপ এবং নিচের দিক থেকে টিবিয়া - এই তিন হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। হাঁটুতে চারটি প্রধান লিগামেন্ট ও দুইটি মেনিসকাস থাকে। লিগামেন্ট হলো ইলাস্টিক টিসু্য যা এক হাড়কে অন্য হাড়ের সাথে যুক্ত করে এবং জোড়ায় শক্তি প্রদান করে ও স্ট্যাবিলিটি রা করে। মিডিয়াল ও ল্যাট্যারাল মেনিসকাস হলো তরম্নণাস্থি যা ফিমার ও টিবিয়া হাড়ের মাঝখানে থাকে এবং সমভাবে ওজন ট্রান্সমিশন করে। হাঁটুর লিগামেন্ট ও মেনিসকাসগুলো নিম্নরূপ :

০ এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট হাঁটুর মাঝখানের সামনের দিকে থাকে। এই লিগামেন্ট লেগের রোটেশনাল ও সামনের মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে।
০ পোসটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট হাঁটুর মাঝখানের পিছনে থাকে এবং লেগের পিছনের মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে।
০ মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট হাঁটুর ভিতর পাশের স্ট্যাবিলিটি মেইনটেইন করে।
০ ল্যাট্যারাল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট হাঁটুর বাহির পাশের স্ট্যাবিলিটি মেইনটেইন করে।
০ মিডিয়াল মেনিসকাস হাঁটুর ভিতর পাশে থাকে এবং সমভাবে ফিমার থেকে টিবিয়াতে ওজন ট্রান্সমিশন করে।
০ ল্যাট্যারাল মেনিসকাস হাঁটুর বাহির পাশে থাকে এবং সমভাবে ফিমার থেকে টিবিয়াতে ওজন ট্রান্সমিশন করে।

লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরির কারণসমূহ :

০ এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্টে সবচেয়ে বেশি ইনজুরি হয়।
০ হঠাৎ টুয়েস্টিং গতি দ্বারা লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি হয়।
০ আঘাত, রিকশা থেকে পড়ে গেলে, গাড়ি বা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এনটেরিওর ও পোসটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি হয়।
০ ফুটবল, বাস্কেটবল, কাবাডি ও হাডুডু খেলোয়াড়দের মেনিসকাস ও ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরি বেশি হয়।
০ মই থেকে পড়ে গেলে।
০ উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়লে।
০ গর্তে পড়ে গেলে।
০ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় এক স্টেপ ভুল করলে।
০ ল্যাট্যারাল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট অপো মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট বেশি ইনজুরি হয় হাঁটুর বাহির পাশে সরাসরি আঘাতের জন্য।
০ ফুটবল ও হকি খেলোয়াড়দের মাঝে মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি হয়।
০ এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরির সাথে ৭০% মেনিসকাস ইনজুরি থাকে।

লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরির লনসমূহ :
০ প্রথমে তীব্র ব্যথা পরে আসত্মে আসত্মে ব্যথা কমে আসে।
০ ব্যথা হাঁটুর বাহির পাশে এবং পিছনে অনুভূত হয়।
০ হাঁটু ভাঁজ বা সোজা করতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায়।
০ আঘাতের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে বা ২/৩ ঘণ্টা পর হাঁটু ফুলে যায়।
০ ফোলা ও ব্যথার জন্য হাঁটু মুভমেন্ট করা যায় না।
০ দাঁড়াতে বা হাঁটতে চেষ্টা করলে মনে হবে হাঁটু ছুটে যাচ্ছে বা বেঁকে যাচ্ছে।
০ আঘাতের সাথে সাথে ব্যক্তি 'পপ' বা 'ক্র্যাক' শব্দ শুনতে বা বুঝতে পারে।
০ মেনিসকাস ইনজুরি সাথে থাকলে রোগী বেশীণ বসলে হাঁটু সোজা করতে কষ্ট হয়।
০ অনেক সময় হাঁটু আটকে যায় তখন রোগী হাঁটুকে নড়াচড়া করিয়ে সোজা করে।
০ দীর্ঘদিন যাবত লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি থাকলে হাঁটুর পেশী শুকিয়ে যায় এবং হাঁটুতে শক্তি কমে যায়।
০ উঁচু-নিচু জায়গায় হাঁটা যায় না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে এবং বসলে উঠতে কষ্ট হয়।
০ হাঁটু ইনসিকিউর বা আনস্ট্যাবল মনে হয়।

জরম্নরী চিকিৎসা :

০ হাঁটুকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।
০ বরফের টুকরো টাওয়ালে বা ফ্রিজের ঠা-া পানি পস্নাস্টিকের ব্যাগে নিয়ে লাগালে ব্যথা ও ফোলা কমে আসবে। প্রতি ঘণ্টায় ১০ মিনিট বা দুই ঘণ্টা পর পর ২০ মিনিট অনবরত লাগাতে হবে। তবে তা সহ্যের মধ্যে রাখতে হবে। এই ব্যবস্থা আঘাতের ৪৮-৭২ ঘণ্টা পর্যনত্ম চলবে।
০ হাঁটুতে ইলাসটো কমপেশন বা স্পিলিন্ট ব্যবহারে ফোলা ও ব্যথা কমে আসে।
০ হাঁটুর নিচে বালিশ দিয়ে হাঁটুকে হার্টের লেবেল থেকে উঁচুতে রাখলে ফোলা কম হবে।
০ এনালজেসিক বা ব্যথানাশক ওষুধ সেবন।
০ হাঁটুর লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরির চিকিৎসা প্রদান করতে সম এমন আথ্রের্াস্কোপিক চিকিৎসকের কাছে বা সেন্টারে রোগীকে পাঠাতে হবে।

প্রাথমিক চিকিৎসায় রোগীর ব্যথা ও ফোলা সেরে ওঠার পর হাঁটুর বিভিন্ন শারীরিক পরীার মাধ্যমে কী কী লিগামেন্ট বা মেনিসকাস ইনজুরি হয়েছে ও এর তীব্রতা নির্ণয় করতে হবে। কখনও কখনও এক্স-রে ও এমআরআই-এর সাহায্য নিতে হয়।

প্রয়োজনীয় চিকিৎসা:
হাঁটুর লিগামেন্ট আপনাআপনি জোড়া লাগে না। তবে কিছুু েেত্র (কোল্যাটারাল লিগামেন্ট ও মেনিসকাসের বাহির অংশ) হাঁটুর পেশীর ব্যায়াম ও দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে সুস্থ থাকা যায়। ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরি হলে নতুন করে লিগামেন্ট তৈরি করতে হয়। এর মধ্যে এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট তৈরি করা জরম্নরী। কারণ এটি না করলে হাঁটুতে তাড়াতাড়ি ওসটিওআর্থ্রাইটিস হয়ে জোড়া নষ্ট হবে। বর্তমানে হাঁটুর বাইরে থেকে টেনডন নিয়ে ছোট দু'টি ছিদ্র দিয়ে আর্থ্রোস্কোপ যন্ত্র হাঁটুতে প্রবেশ করিয়ে নতুন লিগামেন্ট তৈরি করা হয়। বাকেট হ্যান্ডল বা ফ্যাপ মেনিসকাস টিয়ার হলে আথ্রর্োস্কোপের সাহায্যে রিমুভ করা হয়। বর্তমানে মেনিসকাস টিয়ার আথ্রর্োস্কোপের সাহায্যে সেলাই করা সম্ভব। এই অপারেশনের পূর্বে কমপ ে৬ সপ্তাহ হাঁটুর ব্যায়াম করতে হবে এবং অপারেশনের পর ৩ মাস রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে। এই কাজটি শুধু অভিজ্ঞ আথ্রর্োস্কোপিক সার্জনের প েসম্ভব।

ডা. জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন
ফেলো - ট্রমা ও স্পোর্টস সার্জারি- ভারত
ফেলো - আথ্রর্োস্কোপি ও জয়েন্ট রিপেস্নসমেন্ট - ফ্রান্স
কনসালটেন্ট - হাড়, জোড়া, ট্রমা ও আথ্রর্োস্কোপিক সার্জারি

No comments

Powered by Blogger.