লেখকদের সমস্যা এবং ভাষার ব্যাপারে দায়িত্ব by নিয়ামত হোসেন

বাংলা একাডেমীর মেলায় এখন রোজই নতুন নতুন বই আসছে। যতই দিন যাচ্ছে নতুন বইয়ের সংখ্যা ততই বাড়ছে। নতুন পুরনো সব বইয়ের বিক্রিও চলছে।
সারা বছরে যত বই বিক্রি হয় না, অনেক প্রকাশকের প্রকাশ করা বই এই মেলায় সেই রকম বা তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এই বইমেলা নতুন নতুন বই প্রকাশ করা এবং পুরনোর পাশাপাশি সেগুলোর প্রচার তথা বিক্রির চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। কিন্তু আসলে কি বই প্রকাশনার ৰেত্রে লেখকদের সামনের সমস্যাগুলো কেটে গেছে? খ্যাতিমান লেখকদের বিষয় আলাদা, তবে সাধারণভাবে বই প্রকাশের সমস্যা কেটে যায়নি, বিশেষ করে নতুন সম্ভাবনাময় লেখকদের বই প্রকাশ করা এখনও সমস্যা হয়ে রয়েছে।
এখন প্রকাশনার ৰেত্রে এসেছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। বই প্রকাশ করা সহজ হয়ে গেছে। ছাপার মানও অনেক উন্নত হয়েছে। আমাদের দেশে খুব সুন্দর সুন্দর বই এখনই প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশনা ও মুদ্রণের ৰেত্রে খরচ এখনও তেমন কমেনি, বিশেষ করে কাগজের দাম। এটা একটা দিক। দ্বিতীয়ত নতুন লেখকদের এখনও প্রকাশকদের কাছে ঘুরতে হয়। খুব কম প্রকাশকই লেখকের খোঁজ করেন। অবশ্য এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে বইটি ছাপলে তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যাবে প্রকাশকরা সেই বইটি প্রকাশের চেষ্টা করে থাকেন। নতুন লেখকদের বই অধিকাংশ প্রকাশকই প্রকাশ করতে আগ্রহী হন না। সেজন্য বলা যায়, নতুন লেখকদের বই প্রকাশের সুযোগ খুবই কম।
তারপরও দেখা যায়, নতুন নতুন লেখকের অনেক বই প্রতি মেলায় আসে, এবারও আসছে। এখন যে জিনিসটা চালু হয়ে গেছে সেটা হচ্ছে লেখকদের টাকায় বই প্রকাশ করতে হয়। কোন কোন ৰেত্রে লেখক-প্রকাশক উভয়ে মিলে প্রকাশনার ব্যয় বহন করেন। কোন কোন ৰেত্রে সবটাই যায় লেখকদের পকেট থেকে। এসব ৰেত্রে লেখকেরা কী পান? যে টাকা তাঁরা খরচ করেন সেই টাকার বই পান তাঁরা। রয়েলটির কোন প্রশ্ন এখানে থাকে না। দেশে অনেক প্রকাশক রয়েছেন যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য কম, তাঁদের অনেকেই এভাবে মাছে তেলে মাছ ভেজে টিকে আছে কোনমতে। প্রকাশক যখন কোন বইয়ের পেছনে টাকা খরচ করেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই চেষ্টা করবেন যত দ্রম্নত সম্ভব টাকাটা উঠে আসুক। এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য তাঁরা দু'চারজন খ্যাতিমান লেখকের বই ছাড়া অন্যদের বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হন না। সেজন্য এখন প্রকাশনার ৰেত্রে লেখকের টাকায় বই ছাপানোর ব্যবস্থাটা জমে উঠছে। কিন্তু এটা প্রকাশনার ৰেত্রে সুস্থ প্রবণতা নয়। কোন লেখক নিজের উদ্যোগে নিজের খরচে বই প্রকাশ করবেন সেটাও সমস্যার ব্যাপার কারণ সে বই বিক্রি করবেন কোথায়? সেজন্য বিক্রির স্বার্থে কোন না কোন প্রকাশককে ধরতেই হয়। এমন কোন সংস্থা নেই যারা এ ধরনের বই বিক্রির ব্যবস্থা করবে। সরকারী উদ্যোগে এমন ব্যবস্থা থাকলেও সে ব্যবস্থা এমনই যে সেখানে বই দেয়া না দেয়া এক কথা। কাজটা বাংলা একাডেমী করতে পারে। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ৰেত্রে সহায়তার ৰেত্র অনেক। এটাও একটা ৰেত্র। বাংলা একাডেমী নিজের উদ্যোগে বা তার তত্ত্বাবধানে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। এমন একটি সংস্থা বা ব্যবস্থা তারা চালু করতে পারে যেখানে নবীন লেখকেরা বা যে কোন লেখক নিজের খরচে বই বের করে বইয়ের কপিগুলো বিক্রির জন্য সেই সংস্থায় দিয়ে আসবেন। তবে বাংলা একাডেমী আরও বড় কাজ এৰেত্রে করতে পারে। বাংলা একাডেমী বর্তমানে যে কাজগুলো করছে সেগুলোর পাশাপাশি লেখকদের বই ছাপানোর উদ্যোগ নিতে পারে। এজন্য সাহিত্য একাডেমী বা এ ধরনের কোন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সেখানে কয়েকটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। একটি কবিতা বিভাগ, আরেকটি উপন্যাস ও ছোট গল্প, একটি নাটক_এমনি সব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে লেখকদের কাছ থেকে পা-ুলিপি চাইবে এবং যতখানি দ্রম্নত সম্ভব অনুমোদনের পর প্রকাশের ব্যবস্থা করবে। শিশু-কিশোর সাহিত্যের ব্যাপারেও একটা পৃথক বিভাগ হতে পারে। শিশু একাডেমী এ ধরনের বই ছাপে, সেটা কিন্তু যথেষ্ট নয়। শিশু-কিশোর সাহিত্যের অধিক বিকাশের লৰ্যে বাংলা একাডেমীও ভূমিকা নিতে পারে।
এখানে একটা কথা স্মরণ করা যেতে পারে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমী শিশু সাহিত্য প্রকাশ শুরম্ন করে। বেশ কিছু বইও সে সময় প্রকাশিত হয়। এখনও এ ধরনের ব্যবস্থা, বিশেষ করে কবিতা-উপন্যাস, ছোটগল্প ইত্যাদি প্রকাশের ব্যাপারে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগ থাকা দরকার। এ ব্যাপারে টাকার কথা উঠবে হয়তো। সরকারকে এ ব্যাপারে বিশেষ করে ভাবতে হবে। কোন শিল্পের ৰেত্রে যখন দুর্যোগের আশঙ্কা করা হয় বা মন্দার কথা ভাবা হয় তখন তাকে সহায়তার ব্যাপারে সরকার বিভিন্ন সহায়তা তথা উদ্যোগের কথা ভেবে রাখে, বাংলা সাহিত্যের ৰেত্রে এখন যে অবস্থা চলছে তাকে মন্দা ছাড়া আর কী বলা যাবে? এৰেত্রেও বাংলা একাডেমীর মাধ্যমে লেখকদের লেখার ব্যাপারে, বই প্রকাশের ব্যাপারে সহায়তা করা যায় কি না সরকারকে সেটাও ভাবতে হবে। শিৰিত সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে নবীন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হলে স্কুলের বই যেমন দরকার তেমনি স্কুলের বইয়ের বাইরের কিছু সাহিত্যের বইও দরকার। ছেলেমেয়েরা যাতে হাতের কাছে সসত্মায়, সহজে বই পেয়ে যায় এবং স্কুলের বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্যের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় সে উদ্যোগ খুবই জরম্নরী। এই কাজটা যত ভালভাবে করা যাবে দেশের জন্য তত মঙ্গলজনক হবে। দেশের সাহিত্যের বিকাশে সহায়তা করা একটা গুরম্নত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এটা একুশ নির্ধারিত দায়িত্বের একটি।
একুশে ফেব্রম্নয়ারির চেতনাকে বহন করে নিয়ে চলেছি আমরা। সে চেতনা আমাদের শিৰা দিয়েছে ভাষাকে রৰায়, ভাষাকে সুন্দরভাবে ব্যবহারের। আমাদের ভাষা আমরা ভালবাসি, সেই সঙ্গে আমরা অন্যদের ভাষাকেও ভালবাসি। পাকিসত্মানী আমলে বাংলাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলা অৰর বদলে অন্য অৰরে বাংলা লেখার কথাও ভাবা হয়েছিল। এসব ভাবনা-চিনত্মা শুধু বালখিল্যই নয়, মুর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়। সে সব মুর্খামির জবাব আমরা দিয়েছি। বাংলাকে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠা করা তথা রৰা করা হয়েছে। এই বাংলা ভাষার জন্য জীবন দেয়ার দিনটি আজ সারা দুনিয়ায় আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা দুনিয়ায় আমাদের সেই একুশের দিনটির ইতিহাস এখন স্মরণ করা হয়।
মাতৃভাষাকে আমরা সবাই ভালবাসি। আমাদের সবাইকে সুন্দরভাবে শুদ্ধভাবে এ ভাষা ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু আমরা সবাই কি সে চেষ্টা করি? ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি যে ভাষাকে রৰা করার জন্য বরকত-সালাম-রফিক-জব্বারসহ অগণিত মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে সে আমাদের আবহমান কালের বাংলা ভাষা। সেটা আমাদের মা-বাবা-দাদাদের মুখের ভাষা, সেটা আমাদের সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। এই ভাষা ও ঐতিহ্য আমাদের প্রধান সম্পদ। তাই আমরা যারা একুশের চেতনাকে বহন করে চলেছি, আমাদের সবাইকে এই ভাষাকে সুন্দর করে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু আমরা সবাই কি আমাদের ভাষা সবসময় সুন্দরভাবে ব্যবহার করি? বড় মিষ্টি মধুর ভাষা এই বাংলা। উচ্চারণও সুন্দর শ্রম্নতিমধুর। আমরা সবাই শুদ্ধভাবে বহু শব্দ উচ্চারণ করি না। লেখার সময়ও শুদ্ধভাবে লিখি না। বহু স্কুলের ছেলেমেয়ে শুদ্ধ বাংলা লেখা বা উচ্চারণ শেখে না। দুঃখজনক কথা হচ্ছে, কোন কোন স্কুলের শিৰকদের বাংলা উচ্চারণও ঠিক হয় না। তাঁদের কাছ থেকেই ছাত্ররা শেখে ভুল উচ্চারণ। ইংরেজী ভাষা গুরম্নত্বপূর্ণ একটি ভাষা। এ ভাষাও আমাদের শেখা দরকার। কিন্তু দেখা যাবে দীর্ঘদিন স্কুলে ইংরেজী শিখেও বহু ছাত্র ইংরেজীতে কিছু লিখতে পারে না? এমনকি অনেকেরই উচ্চারণও শুদ্ধ হয় না। শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করলে যে কোন ভাষাই শ্রম্নতিমধুর, সুন্দর। আমরা দুনিয়ার সকল জাতির ভাষাকে ভালবাসি, সব ভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে। তাই আমাদের নিজের যে ভাষা সেটার ব্যবহার সুন্দর এবং শুদ্ধ করতে হবে। যখন কিছু লিখব বা বলব তখন শুদ্ধ বলা ও লেখার চেষ্টা করতে হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কোন কোন ৰেত্রে উচ্চারণগত পার্থক্য থাকলেও সেগুলোর ব্যাপারে আপত্তি থাকতে পারে না, কিন্তু বলা বা লেখার ৰেত্রে আদর্শ হিসেবে সর্বমহলে সারাদেশে দীর্ঘকাল ধরে যেটা গৃহীত সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে, সেটাকেই গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন এলাকায় উচ্চারণগত পার্থক্য কিছু কিছু থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের সকল এলাকা, সারাদেশের, সকল মানুষের ভাষা বাংলা। সেই সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, সবার বোধগম্য বিষয়টিই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কেউ কেউ মনে করেন কাজ চললেই হয়, তাই ভাষার ব্যবহার যে কোনভাবে করলেই হলো_এই ধারণা ঠিক নয়, আমাদের এই সুন্দর শ্রম্নতিমধুর ভাষাকে ব্যবহার করতে হবে সুন্দরভাবে, শুদ্ধভাবে; শ্রম্নতিমধুরভাবেই, দায়সারাভাবে নয়।

No comments

Powered by Blogger.