নূরুল আমীন ও তার ভ্রান্ত রাষ্ট্রভাষা নীতি- এমএ বার্ণিক

সরকারের নিকট যে সকল প্রমাণ রহিয়ছে এবং এবং উদ্দেশ্য হাছেলের জন্য যে সকল ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইয়াছিল, তাহা হইতে নিঃসন্দেহে ইহাই প্রমাণিত হয় যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন কম্যুনিষ্ট, বিদেশী চর এবং রাজনৈতিক কারণে অসন্তুষ্ট ব্যক্তিগণ ভিতর হইতে রাষ্ট্রের ধ্বংস সাধনের জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল।'
"২১ ফেব্রুয়ারি তারিখেই ঢাকার জনসাধারণ প্রথম তাহাদের সুপরিকল্পিত কার্যের আভাস দেখিতে পাইলেও আসলে তাহাদের প্রস্তুতি অনেক পূর্ব হইতে চলিতেছিল। বিভিন্ন মহল হইতে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায় যে, পাকিস্তান পরিকল্পনা যাহাদের নিকট অভিসম্পাতস্বরূপ ছিল, তাহারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ কতিপয় রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হইয়া রাষ্ট্রের ধ্বংস সাধন না হইলেও অন্তত ইহাকে দুর্বল করার উদ্দেশে এই প্রদেশে বিশৃক্মখলা সৃষ্টির প্রয়াস পায়। এই উদ্দেশ্যে তাহারা বহুদিন হইতে ব্যাপক যে প্রস্তুতিকার্যও চালাইয়া আসিতেছিল। বেশ কয়েক মাস পূর্ব হইতেই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তিগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছেলেগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য তৎপর ছিল। তাহারা একটি সুযোগের সন্ধান খুঁজিতেছিল মাত্র। বাংলা ভাষার আবেগময়ী আবেদনের মধ্য দিয়ে তাহারা ইহার পূর্ব সুযোগ এবং নিজেদের ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী ঢাকিবার চমৎকার আবরণ পায়। এই পর্যন্ত যে সকল আভাস পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, ঢাকায় ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্রই তাহাদের পরিকল্পনা কার্যকরী করা হইবে। সরকার এই সংবাদ পাইয়াই সম্ভাব্য শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা রোধ করার উদ্দেশ্যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন।"
"রাষ্ট্রের ধ্বংসসাধনের জন্য যাহারা ষড়যন্ত্র করিয়াছিল তাহারা তৎণাৎ এই নির্দেশকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীকে দাবাইয়া দেওয়ার জন্য সরকারী ব্যবস্থা বলিয়া উল্লেখ করে। ইহা ছিল একটি নিছক মিথ্যা অভিযোগ এবং তাহাদের পরিকল্পিত আইনভঙ্গের এবং সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তাহাদের দৃঢ় সঙ্কল্পতার অনুকূলে জনসাধারণের সহানুভূতি লাভের একটি উপায়।" নিম্নোক্ত তথ্যাদি হইতেই ইহা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইবে।
"২১শে ফেব্রুয়ারির মাত্র এক পকাল পূর্বে ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জনসভা ও মিছিল হইতে থাকে। অথচ সরকার কোথাও তাহাতে এতটুকু হস্তপে করেন নাই।"
১৪৪ ধারা জারির দ্বারাও এই ধরনের সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয় নাই। তবে ইহা করার জন্য পূবর্্বাহ্নে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লইতে হইত; কিন্তু সেই অনুমতি কখনও চাওয়া হয় নাই। এমনকি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সুপারিশ জানাইয়া পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণ করার পরেও এই অরাজকতা সৃষ্টিকারীগণ বিরত হয় নাই। প্রকৃতপ েনিজেদের উদ্দেশ্যে হাছেলের জন্য তাহারা দ্বিগুণ শক্তিতে কাজ করিতে থাকে। এইভাবে ইহা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিশৃক্মখলা সৃষ্টিকারীদের নিকট ভাষা সমস্যাটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; বরং তাহাদের এই ধ্বংসাত্মক কার্যে জনসাধারণকে প্রতারিত করিয়া সমর্থন বা সহানুভূতি লাভেরই একটি কৌশল ছিল মাত্র। ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তাহারা শান্তিভঙ্গের যে আন্দোলন শুরু করে, তাহা বাংলাভাষার অনুকূলে গণস্বাধীনতাকে খর্ব করার জন্য সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বালিয়া প্রকাশ করা হয়। ইহাও যে নিছক মিথ্যা তাহা নিম্নোক্ত তথ্যাদি হইতে প্রমাণিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরদিন সকালেই প্রদেশে বিশৃক্মখলা সৃষ্টির এবং বলপূর্বক সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তাহাদের ব্যাপক পরিকল্পনা কার্যকরী করিতে আরম্ভ করা হয়। ইতোপূর্বে তাহাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে সরকার যে সংবাদ পাইয়াছিলেন তাহা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক এই পরিকল্পনার ধরন হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, এক রাত্রির মধ্যেই এই ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ণ করা সম্ভবপর হয় নাই।
২১ ফেব্রুয়ারি একদল ছাত্র ও জনসাধারণকে উত্তেজিত করিয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নিকট পুলিশের সঙ্গে এক সংঘর্ষে লিপ্ত করা হয়। ফলে তিনজন নিহত হয়। তন্মধ্যে একজন মাত্র ছাত্র ছিল। হতাহতদের সংখ্যা সম্পর্কে নিমিষের মধ্যে সারা শহরে গুজব রটানো হয়। হতাহতদের সংখ্যা সম্পর্কে বিশেষভাবে অতিরঞ্জিত সংবাদ রটানো হয় এবং পরের দিনের মধ্যেই নানা প্রকার ধ্বংসাত্মক প্রচারপত্র দ্বারা সারা শহর ছাইয়া ফেলা হয় এবং সবচেয়ে উত্তেজনামূলক প্রচারপত্রগুলো লাল কালিতে প্রতিশোধ দাবি করিয়া কমু্যনিস্টদের নেহায়েত পরিচিত ধরনে লেখা ছিল। সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের নেতা মওলানা ভাসানী নিহতদের সংখ্যা ১৭ জন বলিয়া উল্লেখ করেন। মোমেনশাহী ও প্রদেশের অন্যান্য স্থানের প্রচারপত্রে নিহতদের সংখ্যা ১১ জন বালিকাসহ ১৬ জন বলিয়া প্রচার করা হয়।
'এই সকল ধ্বংসাত্মক প্রচারপত্রে যে রাতারাতি বা ১৪৪ ধারা জারির পরে ছাপানো হয় নাই, তাহা ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখেই এই রকম অনেক প্রচারপত্র সন্দ্বীপের ন্যায় দূরবতর্ী স্থানেও প্রচার করা হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি তারিখের গুলিবর্ষণের পরেই ঢাকার সকল সংবাদপত্রকেই ভীতি প্রদর্শন করিয়া তাহাদের দাবি সমর্থন করিয়া সরকারী কার্যকলাপের নিন্দা করিতে বলা হয়। এমন কি পরবতর্ী দিবসে মর্নিং নিউজ অফিস ভস্মীভূত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগ পার্টি হইতে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যগণকে মারপিটের ভয় দেখানো হয়। তাছাড়া বহু সরকারী কর্মচারীকেও শাসনব্যবস্থা অচল করার জন্য কার্যে যোগদানে বিরহ হইতে বলা হয়। তিন দিবস ধরিয়া বহু দোকানপাট ও যানবাহনকেও হরতাল পালনে বাধ্য করা হয়। স্থানীয় ডাক ও তার বিভাগের কাজ এবং ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার জন্য অনুরূপভাবে চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তান রেডিওর কাজ ব্যাহত করার জন্যও চেষ্টা করা হয়।
প্রথম হইতে কেবলমাত্র আমার সরকারের নিকটই নয় বরং প্রত্যেকের নিকটই ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল যে, বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হইবে কিনা ইহাই এখানে আসল ব্যাপার ছিল না। যাহারা এই বিশৃক্মখলার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, তাহারা প্রকৃতপ েভীতি ও বল প্রদর্শন দ্বারা সরকারের পতন ঘটাইয়া তাহার স্থলে একটি ক্রীড়নক সরকার বসাইতে দৃঢ় সংকল্প ছিল। এই সরকার তাহাদের নির্দেশ অনুযায়ী চলিয়া আসল উদ্দেশ্য হাসেলে সহায়তা করিবে_ ইহাই তাহাদের ধারণা ছিল।
এই পরিষদ সদস্যগণ অবগত আছেন যে, নারায়ণগঞ্জে এক শোভাযাত্রায় বিােভকারীগণ 'জয়হিন্দ' ও 'যুক্তবাংলা চাই' প্রতিধ্বনি উচ্চারণ করিয়াছিল।
দেশে বিভাগের পর আর কখনও এরূপ হয় নাই। এইবারই প্রথম এই সুযোগে পাকিস্তানের শত্রুগণ আত্মপ্রকাশ করিবার সাহস পায়। এমতাবস্থায় সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকির মোকাবেলা করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না কারিয়া পারেন না। অখণ্ড মনোযোগ লইয়া এই ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যেই পরিষদের অধিবেশন আপাতত মূলতবি রাখা হয়।
ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ও বাহিরে ষড়যন্ত্রের কয়েকজন নেতাকে সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করা হয়। পরিষদের ৫ জন সদস্য মিঃ মনোরঞ্জন ধর, মিঃ গোবিন্দলাল ব্যনার্জি, মিঃ সতীন সেন, জনাব খয়রাত হোসেন ও জনাব আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকেও এই সময় গ্রেফতার করা হয়। প্রকাশ্যভাবে আইন অমান্য করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভিতরে ছাত্রগণ ও বাহিরের লোকের দ্বারা মাইকযোগে অনবরত যে উত্তেজনামূলক বক্তৃতা দেওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ তাহা দমন করিতে ব্যর্থ হওয়ায়, পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করিয়া মাইকগুলি কাড়িয়া লয়। এই সমস্ত বক্তৃতার কেন্দ্র সলিমুল্লাহ মুসলিম হলেও তল্লাশিকার্য চালান হয়। তল্লাশির ফলে উক্ত হল হইতে ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা সম্পকর্ীয় বহু কাগজপত্র ও পুস্তিকা এবং লাইসেন্সবিহীন একটি বন্দুক পাওয়া যায়। ষড়যন্ত্র সম্পকর্ীয় এই সকল কাগজপত্র ও পুস্তিকা বহুদিন পূর্ব হইতেই যোগাড় করিয়া রাখা হইয়াছিল।
যাহা হোক, সরকার কর্তৃক যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করায় এবং জেলা কতর্ৃপ, সৈন্যবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা ও ধৈর্যের ফলে ২৪ ফেব্রুয়ারির পরই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসে। ইহার জন্য আর কোনরূপ বলপ্রয়োগ করিতে হয় নাই। ইহা নিঃসন্দেহে সরকারের একটি খুবই বড় কীর্তি এবং যেরূপ কৌশল ও সুবিবেচনার সহিত তাহারা একটি গভীর ষড়যন্ত্র ও জটিল পরিস্থিতি দমন করিয়া শৃক্মখলা ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, তাহার জন্য তাঁহারা বাস্তবিক ধন্যবাদ ও প্রশংসা পাইবার যোগ্য। কোনরূপ বলপ্রয়োগ না কারিয়া পুলিশ ও সৈন্যবাহিনীর লোকেরাও যে ভাবে কাজ করিয়া গিয়া শান্তি ও শৃক্মখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, তাহার জন্য কৃতিত্বের অনেকখানি তাঁহাদেরও প্রাপ্য।
'রাজধানী ঢাকা শহরের বাহিরে_ একামত্র নারায়ণগঞ্জেই আইনভঙ্গ কার্য অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একটি জনতা ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা প্ররোচিত হইয়া পুলিশ দলকে আক্রমণ করে এবং তহবিল তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত ও ধৃত একজন মহিলা শিয়িত্রীকে তাহাদের নিকট হইতে কাড়িয়া লয়। শিয়িত্রীটিকে তহবিল তছরুপের দায়ে গ্রেফতার করা হইলেও ষড়যন্ত্রকারীরা এই বলিয়া লোকজনকে পোইয়া তুলে যে, তাহাকে বাংলাভাষার প েআন্দোলনের অপরাধেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনা সম্পর্কে জনাব ওসমান আলী নামক একজন এমএলএকেও গ্রেফতার করা হয়। তাঁহার বাড়িটি ছিল আইন ভঙ্গকারীদের একটি কেন্দ্র। তল্লাশি করিয়া তাঁহার বাড়ি হইতে বহু বিজ্ঞাপন ও পুস্তিকা পাওয়া গিয়াছে। এই েেত্র আর যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে কয়েকজন হিন্দু যুবকও আছে। এই হিন্দু যুবকগণ কিছুদিন পূর্বে পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করে এবং মুসলমানের ছদ্মবেশে চলাফেরা করিতেছিল। চট্টগ্রাম রাজশাহী প্রভৃতি কয়েকটি স্থানেও এরূপ আরও কয়েকজন বিদেশীকে গ্রেফতার করা হইয়াছে।
সুখের বিষয় যে প্রদেশের জেলাগুলোতে এই ধ্বংসাত্মক আন্দোলন ছাড়াইতে পারে নাই। তৎপূর্বেই ষড়যন্ত্রের নেতাগণকে গ্রেফতার করা হয়। তবে কয়েক স্থানে রেল লাইনে গোলযোগ ঘটানোর চেষ্টা চলে এবং কয়েক জায়গায় সভা অনুষ্ঠান করিয়া উত্তেজনামূলক বক্তৃতা দেওয়া হয়।
ঢাকার মতো প্রদেশের অন্যান্য শহরগুলোতে ধ্বংসাত্মককার্য সম্পর্কে হাজার হাজার বিজ্ঞাপন ছড়ান হয়। জনগণকে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে এই সমস্ত বিজ্ঞাপনে ঢাকার ঘটনা সম্পর্কে অতিরিক্ত, চরম মিথ্যা ও খুবই উত্তেজনামূলক বর্ণনা দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ বরিশালে বিলিকৃত এইরূপ একটি প্রচারপত্রে বলা হইয়াছে যে, ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনায় পুলিশ স্টেনগান ব্যবহার করিয়াছে এবং ৫ জন ছাত্র নিহত হইয়াছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হইল ৩ জন মারা গিয়াছে এবং নিহতদের মধ্যে ছাত্র একজন। গুলি চালানায় কোন স্টেনগান ব্যবহৃত হয় নাই । উক্ত প্রচারপত্রের আরও বলা হইয়াছে_ ২২ ফেব্রুয়ারি লরী বোঝাই সৈন্যগণ সারাণ স্টেনগানের গুলি ছুড়িতে ছুড়িতে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে। প্রকৃতপ,ে সৈন্যগণ একবারও গুলি ছোড়ে নাই এবং কোন ব্যক্তির ওপর কোন বল প্রয়োগও করে নাই। প্রচারপত্রের পরিষদ সদস্যগণকে পূর্ব বঙ্গের দালাল বলা হয় এবং দেশবাসীগণকে আন্দোলনে যোগ দিয়া বিদ্রোহ করিতে উস্কানি দেওয়া হয়। প্রচারপত্রে বলা হয়, ঢাকার রাস্তাঘাট শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হইয়াছে। 'রক্তের বদলে রক্ত চাই' প্রতিজ্ঞা গ্রহণের জন্য এবং বিদ্রোহের দ্বারা বর্তমান সরকারের সমাধি রচনা করার জন্য প্রচারপত্রে দেশবাসীর নিকট আবেদন জানান হয়। এই সকল বিজ্ঞাপনের অধিকাংশই যে পাকিস্তানের বাহির হইতে আসিয়াছে তাহাও বিশ্বাস করিবার মতো যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
অনুরূপভাবে অসংখ্য ভিত্তিহীন গুজব বিভিন্ন জেলায় ছড়ান হয়। এইসব গুজবে বলা যে সরকারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে অথবা সরকারের পতন ঘটিয়াছে। আমার মোমেনশাহী বাড়িটি ভস্মীভূত করা হইয়াছে, একদল বাঙালী পুলিশ সরকারী নির্দেশ পালন করিবে না বলিয়া সন্দেহ হওয়ায় তাহাদিগকে বরখাস্ত করা হইয়াছে। গুলিবর্ষণের ফলে ঢাকায় শত শত লোক নিহত হইয়াছে, পুলিশ ও সৈন্যগণ রাস্তা হইতে মৃতদেহগুলো লরী বোঝাই করিয়া লইয়া যাইয়া জ্বালাইয়া ফেলিয়াছে এবং জানাজা না পড়িয়া নিহত ছাত্রগণকে গোপনে মাটি চাপা দেওয়া হইয়ছে বলিয়াও চতুর্দিকে গুজব ছড়ান হয়। এই সমস্ত গুজবের প্রত্যেকটি নিলর্জা মিথ্যা।
প্রকৃত ঘটনা হইল_ ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ফলে দুর্ভাগ্যক্রমে ১ জন ছাত্রসহ ৩ ব্যক্তি নিহত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে আরও ১ ব্যক্তি নিহত হয়। শেষোক্ত দিন মোটর দুর্ঘটনায় অপর ২ ব্যক্তি নিহত হয়। গোলমালের সহিত এই ঘটনার কোন সম্পর্ক নাই। মাওলানা হাফেজ আবদুর গফুর নিহত ৬ ব্যক্তিরই জানাজা পাঠ করেন। নিহতদের যে সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছে, তাঁহারা নিহতদের জানাজার সময় ও কবর দেওয়ার সময় উপস্থি ছিলেন। দু'জন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের (জনাব মোহাম্মদ ইউসুফ ও জনাব ওবায়েদুল্লাহ) তত্ত্বাবধানে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.