ভালবাসি থেকে আই লাভ ইউ by রাহুল শর্মা

'যেন কিছু মনে করো না, কেউ যদি কিছু বলে, কত কি যে সয়ে যেতে হয় ভালবাসা হলে।' জনপ্রিয় এই গানের কলি আজ একেবারেই অচল। এখন ভালবাসা কোন অপরাধ নয়।
তরম্নণ-তরম্নণীর হৃদয় বাঁধবে একই বাঁধনে_ এটাই স্বাভাবিক। ভালবাসা পবিত্র, শাশ্বত, স্বর্গীয়। ভালবাসার প্রধান ভিত্তি বিশ্বাস, সততা, পবিত্রতা। মানুষ ভালবাসার বোধ নিয়েই জন্মায়। ভালবাসা হচ্ছে ভেতরের টান, কোমল ব্যাকুলতা ও আনন্দ। ভালবাসা বহু মাত্রা ও আয়তনে ভরা। সনত্মানের প্রতি স্নেহ, বন্ধুর প্রতি অনুরাগ, প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা, জীবনের প্রতি প্রেম- এ সবই ভালবাসা। ভালবাসা কী? প্রশ্ন করলে হয়ত কোন সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না। তবে এ কথা বলা যায়, ভালবাসার মানুষটির ভাল কামনা করাও ভালবাসা।

প্রথমে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী
কারও চোখ, কারও মুখ ভাল লাগে, আবার কেউবা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো ''চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা''-এ মত্ত হন। ভালবাসার েেত্র প্রথম দর্শনে ভাল লাগার ব্যাপারটি সবসময় না ঘটলেও ভাল লাগার মানুষটির কোন একটি বিশেষ দিক বা মুহূর্ত সবসময়ের জন্যই ভাল লাগে। কারণ প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা মনোদৈহিক বৈশিষ্ট্য।
প্রথম দর্শনে প্রেম_ আগের যুগেই বেশি হতো। কারণ তখন ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশার সুযোগ ছিল কম। তাই একটুস খানি দেখাতেই সীমাবদ্ধ ছিল সব। আর এতেই ভালবাসা। গুণ বিচারের সময় থাকত না। সে হতো বিয়ের পর। সময় পাল্টেছে। এখন প্রথমে দর্শনধারী নয়, গুণ বিচার। এ সব কিছুর মধ্যে যদি বাসত্মবতা, নিজের অবস্থান ও পারিবারিক অবস্থার কথা স্মরণ করতে পারেন তাহলেই আপনার ভালবাসা হবে অনেকটা ঝঞ্ঝাটমুক্ত। যা ভালবাসার মানুষটিকে জয় করতে আপনাকে সাহায্য করবে। তবে অনেকে ভালবাসার েেত্র এগুলো বিবেচনার পপাতী নন। তাদের কাছে ভালবাসার েেত্র এগুলো থাকবে কেন? হ্যাঁ আমিও বলি_ এগুলো থাকবে কেন? এগুলো না থাকার পরিণতি যে কত ভয়াবহ, নির্মম ও নিষ্ঠুর তা বাসত্মবতা ও ইতিহাসই আমাদের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয়।
আর একটা কথা প্রথম দিকের উত্তপ্ততা কখনই ভাল নয়। দার্শনিক জন হে উড বলেছেন_''অতি উত্তপ্ত ভালবাসা খুব শীঘ্রই শীতল হয়ে যায়।'' সুতরাং কখনই ভালবাসার েেত্র মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ততাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত নয়। সাধারণত এই সময়ে প্রথম দিকের উত্তপ্ততাকে ছেলেমেয়ে উভয়েই প্রচ- ভালবাসা বলে মনে করে। আর এখানেই বিপদ। এক সময় তা কাঁচের আয়নার মতো সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।

ভালবাসি থেকে
আই লাভ ইউ
প্রেম বা ভালবাসা যাই বলি না কেন, আসলে তা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তবু প্রেম শুনলেই মন কেমন করে ওঠে। একটু নাক সিটকানো ভাব, একটু দূরে ঠেলে দেয়া। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ প্রেম শুনতে রাজি না হলেও ভালবাসার ব্যাপারে গররাজি। এই তো কয়েক বছর আগেও ছেলেমেয়েরা প্রেম করত লুকিয়ে, আড়াল রেখে। যেন প্রেমের মতো অপরাধ আর নেই। এখন সে ভয় নেই। আজ প্রেমের েেত্র ছেলে ও মেয়ে উভয়েই সাহসী। আগের প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ভালবাসার পাত্র-পাত্রী হিসেবেই পরিচিত করানো হতো। এখন প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, তারা বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড।
আগের প্রেমিক-প্রেমিকার চিঠি শুরম্নই হতো নানান ছন্দবদ্ধ শেস্নাক দিয়ে। যা এখন প্রাচীন, গেঁয়ো সংস্কৃতির অংশ। আজকের ভাষা অনেক বেশি স্মার্ট। চিঠির যুগ শেষে এসেছে এসএমএস। মুহূর্তের মধ্যে পেঁৗছে দিচ্ছে প্রেমিক হৃদয়ের আকুলতা। 'জ্বর কমেছে' 'ওষুধ খোয়ো' 'নিজের প্রতি যত্ন নিয়ো', 'ভাল থাক'। আগে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে উপহারের প্রচলন বেশি ছিল না। ছিল না বিভিন্ন দিবসের ঘনঘটাও। আর দেখা সাাৎই যেখানে নেই, সেখানে উপহার তো অনেক দূরের বিষয়। উপহারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল নক্সী রম্নমাল। তবে সে রম্নমাল এক টাকা দিয়ে হলেও কিনে নিতে হতো। না হলে ঝগড়া হবার সম্ভাবনা থেকে যায়! আশি এবং নব্বইয়ের দশকে ঈদকার্ড, ভিউকার্ডের প্রচলন ছিল বেশ। এখন ঈদ পার্বণে এসএসএস। সময়ের সঙ্গে পালস্না দিয়ে উপহারের পালস্নাও ভারি হয়েছে। দামী পোশাক, গহনার মতো দ্রব্যাদির হালের তরম্নণ-তরম্নণীরা প্রিয়জনকে উপহার হিসেবে দিচ্ছে।

বাড়ছে ছলাকলার কৌশল
বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। মানুষের কাছে থাকার আকুলতা সব সময়ের। এ আকুলতা থেকেই ভালবাসার গভীরতা। সেকালে মনের মানুষকে প্রিয় কোন নাম ধরে ডাকতে দ্বিধা করত। এই শুনছ-তেই সীমাবদ্ধ থাকত। আর স্ত্রীরা তো আরও লাজুক। তার শব্দের ভা-ার হঁ্যা গো, ওগোর মধ্যেই বাঁধা থাকত। শ্বশুড়-শাশুড়ির সামনে স্বামীর নাম ধরে ডাকা ছিল কল্পনার বাইরে। 'আপনার ছেলে' আর নিজের সনত্মান থাকলে তার নামেই বাবা-মা পরস্পরকে ডাকার কাজ সেরে নিতেন। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে গেছে আগের এই রীতিগুলো। এর সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে ছলাকলার কৌশল। সত্যিকারের ভালবাসার েেত্র এই ছলাকলা কখনই থাকতে পারে না। সত্য যতই কঠিন হোক তা অবশ্যই মেনে নিতে হবে। পরস্পরের সঙ্গে তা বিনিময় করতে হবে। এক মুহূর্তের জন্যও তার মনের গহীনে যেন কোন অজানা কথা ঘুরপাক না খায়। সেদিকে থাকতে হবে সদাসচেষ্ট। সম্পর্ক গড়ার আগেও যদি আপনার জীবনে কোন ঘটনা বা তার না জানা কথা থাকে তাহলে খুলে বলুন সব। সব সময় এড়িয়ে চলতে হবে ছলাকলার কৌশল।

খসে পড়ছে আব্রম্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে বিশ্বাস
ভেঙ্গে যাচ্ছে যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবারের আবহ যেমন খুঁজে পাওয়া কঠিন। তেমনি করে ভেঙ্গে পড়ছে আমাদের মূল্যবোধ। আমাদের আব্রম্ন, আমাদের বিশ্বাস। নদীর একূল ভেঙ্গে ওকূল গড়ার মতোই প্রতিনিয়ত ভাঙছে সম্পর্ক, আবার পরমুহূর্তেই গড়ে উঠছে নতুন সম্পর্ক। কাছে থাকার আকুলতার পরও মানুষ ক্রমশ দূরে যাচ্ছে। সম্পর্কের সেতু তৈরির আগেই তার ভিত নড়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মনোবিদ হলব্রম্নক জ্যাকসন বলেন, এ রকম সমস্যার জন্য প্রধানত দায়ী মাত্রাতিরিক্ত আবেগ। কোন সম্পর্ক সৃষ্টির েেত্র শুধুমাত্র ভাল লাগাকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য না দিয়ে সমাজ, বাসত্মবতা, পরিবারের কথাও মাথায় রাখা উচিত। তাহলে সম্পর্ক ভাঙ্গার-গড়ার এই খেলায় আপনার অবস্থান নিয়ে কখনও নিজেকে অপরাধী ভাবতে হবে না।
মুঠোফোন আর ফেসবুকের কল্যাণে ড্রয়িংরম্নম থেকে বেডরম্নমে চলে এসেছে বিশ্ব। মধ্যরাতের পৃথিবী যখন সুনসান নীরবতায় নিমগ্ন, তখনই হাওয়াই সংযোগে ডাক আসে।
তুমি কি জেগে আছ? কি কর?
বিশ্ব যত সহজে হাতছানি দিয়ে চলে এসেছে আমাদের কাছে, ঠিক ততটাই দ্রম্নত সরে যাচ্ছে। কারণ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টার কথায় শুধুই ভালবাসার কথা থাকে না। রাতের রহস্যময়তায় যখন একজন কিশোরী বা তরম্নণীর ঘরে একানত্ম আপন মুহূর্তে নিশি ডেকে ওঠে, তখন সেখানে আরও কিছু ভর করে। কথার জাল বুনে তখন প্রেমিক হৃদয় হয়ত সাঁতরে ফিরতে চায় অজানা বন্দরে। অজানা এই বন্দরেই ভর করে বিপদ নামের সাইরেন। আর তখনই খসে পড়ে আমাদের মধ্যবিত্তের আব্রম্ন। এত সহজে যখন কানের পাশে ফিসফিস শব্দে নিশি ডাকে, তখন কতদিন; কতকাল নিজেকে ধরে রাখা যায়! তখনই ভেঙ্গে পড়ে সম্পর্কের ভিত। আমাদের আব্রম্ন, আমাদের বিশ্বাস। হয়ত এটাই সত্য, হয়ত নয়। সুতরাং সাবধান।

বদলে যাচ্ছে ভালবাসা
বর্তমান সময়ে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ভালবাসার ধরন। এখনকার ভালবাসার সংজ্ঞার মধ্যে ঢুকে পড়ছে যৌনতা। মিথ্যা প্রেমের আশ্বাসে অনেকে ন্যায়-অন্যায় , ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের বোধ ভুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে শারীরিক সম্পর্কে। ভালবাসার অন্যতম ভিত্তি বিশ্বাস। বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তা ভঙ্গ করা অন্যায়। এ প্রসঙ্গে নন্দিত কথা সাহিত্যিক হরিপদ দত্ত বলেন, ভালবাসা মানেই শরীর সানি্নধ্য নয়। ভালবাসার অনিবার্যতায় যদি যুবক-যুবতীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা উভয়ের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। ছিন্ন হতে পারে পারিবারিক বন্ধন, বিঘ্ন ঘটতে পারে পড়াশোনায়। ভালবাসার নামে যৌন মিলনে যুবক-যুবতীকে হারাতে হয় অনেক কিছু। বাবা-মার ভালবাসা থেকে শুরম্ন করে পারিবারিক নিরাপত্তার ছায়া। এক সময় শরীর মন ত-বিত হতে হতে তীব্র হতাশায় ডুবে যায় প্রেমিক-প্রেমিকা।

তবুও স্বপ্ন দেখে মন
তবু আমরা স্বপ্ন দেখি আগামীর। দিনবদলের। সামনে এগিয়ে যাবার। পৃথিবীজুড়ে হানাহানি রোধের উপায় হিসেবে ভালবাসাই হতে পারে প্রধান হাতিয়ার। যার ফলে মানুষে মানুষে হিংসা, বিদ্বেষ কমে যাবে। কমে যাবে যুদ্ধের ভয়াবহতা, নিরীহ মানুষ আর যুদ্ধাহত শিশুর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠবে না আধুনিক পৃথিবীর বাতাস। এমনই প্রত্যাশা করি।

No comments

Powered by Blogger.