বিদ্যুত খাতের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার শুভ উদ্যোগ by শেখর ইমতিয়াজ

বর্তমান বিশ্বে একটি সত্য সর্বজনস্বীকৃত যে, কোন দেশের শিল্পবাণিজ্য, কলকারখানা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সাবলীলতা আনার েেত্র প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে বিদ্যুত।
বিদ্যুতের উৎপাদন ও বণ্টনে আনুপাতিক স্বচ্ছতা খুবই জরুরী। এ বিষয়ে আমাদের নিকট অতীত খুবই করুণ অভিজ্ঞতার সময়কাল। বিদ্যুত চাইতে গিয়ে কৃষককে প্রাণ দিতে হয়েছে, শিার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারেনি। বন্ধ থেকেছে কলকারখানা, মুখ থুবড়ে পড়েছে শিল্পবাণিজ্য। কৃষকের মাঠ হয়ে উঠেছিল অনুর্বর, ুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা লোকসানের অঙ্ক কষেছে কেবল। প্রায় সাতটি বছর কেটেছে বিপুল নৈরাশ্যের মধ্যে। এসব তিক্ত অধ্যায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ক্রমবর্ধমান বিদু্যত চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করার ল্যে বর্তমান সরকার বিদ্যুতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করে যে সব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তাতে দেশবাসী কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আশার আলোটি যেন ীণ প্রদীপ না হয় এবং কার্যক্রম গ্রহণ যেন বাসত্মবায়িত হয়। শুভ পরিবর্তনের প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে দেশবাসী পোড়খাওয়া মানুষ হয়ে ঠিকে আছে। আর যেন এদের প্রত্যাশায় ফাটল না ধরে। সিদ্ধিরগঞ্জ বিদু্যতকেন্দ্রের ১২০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করার মাধ্যমে নতুনভাবে আশান্বিত হওয়া দেশবাসীর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম, বর্তমান সরকারের ইতিবাচক পদেেপ উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর এসব বিনিয়োগ যথাযথ কাজে লাগিয়ে আগামী দু'বছরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে নতুন সাত হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত যোগ করা হবে। একটা বিষয় অবশ্যই স্বীকার্য, সরকার গঠনের এক বছরের মধ্যে নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র উদ্বোধন করতে পারা একটি বড় সাফল্য।
১৯৯৬ সালে এক হাজার ছয় শ' মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন নিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে যাত্রা শুরু হয়েছিল। পাঁচ বছরের মধ্যে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল চার হাজার তিন শ' মেগাওয়াটে। অথচ বর্তমান মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় বিদু্যত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৬৭ মেগাওয়াট, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে চার হাজার ২৯৬ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিপুল পরিমাণের টাকা নয়-ছয় করেছে। বিদু্যত উৎপাদন ভয়ঙ্কররূপে ব্যাহত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে জ্বালানি খাতকে বিশেষ গুরম্নত্ব দিয়ে বর্তমান সরকার স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ২০১১ সালের মধ্যে ৮২০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার পস্ন্যান্ট, ২০১৩ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক দু'হাজার ছয় শ' মেগাওয়াটসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন করার ল্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে বিদু্যতের সুবিধাভোগীদের হার শতভাগে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি দেশবাসীর প্রতি অত্যনত্ম সময়োপযোগী এবং বাসত্মবভিত্তিক আহ্বান জানিয়ে বিদু্যত সাশ্রয়ে ব্যবসায়ীদের এবং স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় সোলার সিস্টেম ব্যবহারের কথা উলেস্নখ করেন। ইতোমধ্যে বিদু্যত সঙ্কট মোকাবেলায় সোলার সিস্টেম, জলবিদু্যত, বায়ো পস্ন্যান্ট, কয়লাভিত্তিক বিদু্যত পস্ন্যান্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
যে মুহূর্তে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদু্যতকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটির উদ্বোধন হলো সে মুহূর্তটি কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল ইরি-বোরো চাষের মৌসুম শুরম্ন হয়েছে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ল্যে এখন গ্রামে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদু্যত সরবরাহ করার প্রতি গুরম্নত্ব দিয়েছে সরকার। এ জন্য শহরবাসীর প্রয়োজন বিদু্যতের অপচয় না করা। কারণ শহরবাসীর স্মরণে থাকা ভাল, ঘরে ঘরে বিদু্যতের সাথে চালের সরবরাহও স্বাভাবিক থাকা প্রয়োজন। উলেস্নখ্য, গড়ে বিদু্যত চাহিদা শতকরা আট ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বর্তমান বিদু্যত গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি বিশ লাখ। আগামী গ্রীষ্মকালে বিদু্যত চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে সঙ্কটও।
বিদ্যমান গ্যাস সঙ্কটের প্রোপটে বিকল্প জ্বালানিভিত্তিক নতুন পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা প্রকট হয়ে উঠেছে। তাই ভবিষ্যতে আমদানিকৃত কয়লা ও তরলীকৃত গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) বিদু্যত কেন্দ্র স্থাপন বিবেচনায় রাখছে সরকার। বিগত বছরগুলোতে বিদু্যত চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় রেখে বিদু্যত উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন না হওয়ায় চাহিদা ও উৎপাদন ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা ছাড়া কোন বিকল্প উপায় নেই। অতি দ্রম্নত বাসত্মবায়নের জন্য এবং প্রাথমিক জ্বালানি প্রাপ্যতা বিবেচনায় ডিজেল ও ফারনেস অয়েলভিত্তিক পাঁচ শ' ত্রিশ মেগাওয়াট মতার রেন্টাল বিদু্যত কেন্দ্র আগামী আগস্টের মধ্যে বাসত্মবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারী সূত্র মোতাবেক, ইতোমধ্যে এই উদ্যোগের ২৬৫ মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদনের চুক্তি স্বারিত হয়েছে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বাসত্মবায়নের জন্য সরকারী খাতে আট শ' বিশ মেগাওয়াট মতার তেলভিত্তিক বিদু্যতকেন্দ্র স্থাপনের পদপে গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বমোট তিন শ' পঞ্চাশ মেগাওয়াট মতার পাঁচটি বিদু্যতকেন্দ্র স্থাপনের ক্রয় প্রসত্মাব সরকারের ক্রয়সংক্রানত্ম মন্ত্রিসভা কমিটি কতর্ৃক অনুমোদিত হয়েছে। বেসরকারী খাতে কালিয়াকৈর ও সাভারে প্রতিটি এক শ' মেগাওয়াট মতার পিকিং পস্ন্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে বিদু্যত উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে।
ইতোমধ্যে বিবিয়ানায়, ভোলায় ও মেঘনাঘাটে কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন বিদু্যতকেন্দ্র বেসরকারী খাতে স্থাপন প্রক্রিয়া শুরম্ন হয়েছে। এ েেত্র উলেস্নখযোগ্য উদ্যোগ হচ্ছে আমদানি করা কয়লাভিত্তিক দু'হাজার ছয় শ' মেগাওয়াট মতার দ বিদু্যতকেন্দ্র স্থাপন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ সকল উদ্যোগ যথাসময়ে বাসত্মবায়িত হলে আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে বিদু্যতের ভয়াবহ সঙ্কট থেকে দেশ মুক্ত হবে। এ ল্য পূরণে প্রায় দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। তাতে অবশ্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে।
সরকারের রয়েছে আণবিক শক্তিচালিত ও কয়লাভিত্তিক বড় বিদু্যতকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির আওতায় ইতোমধ্যে এক শ' থেকে দু'শ' মেগাওয়াট বিদু্যতকেন্দ্র ও নয় থেকে চৌদ্দ মেগাওয়াট সৌর বিদু্যতকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরম্ন করা হয়েছে। আনত্মর্দেশীয় বাণিজ্যের আওতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল, ভুটান ও নেপাল থেকে বিদু্যত আমদানির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ২০১২ সালের মধ্যে দু'শ' পঞ্চাশ থেকে পাঁচ শ' মেগাওয়াট বিদু্যত আমদানি কার্যক্রম শুরম্নু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকার কতর্ৃক গৃহীত বিদু্যত সাশ্রয়ী কার্যক্রমের প্রতি গ্রাহকদের সমর্থন থাকা জরম্নরী। নাগারিকেরও রয়েছে সরকারী পদপেগুলোকে সচল রাখতে সহযোগিতা করা। সে জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে হলিডে স্ট্যাগারিং কার্যকর রাখা এবং রাত আটটার পর শপিংমল ও মার্কেট বন্ধ রাখা উচিত। সকল সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিদু্যত সাশ্রয়ী বাল্ব স্থাপন কার্যক্রম গ্রহণ, সকল অফিসে এয়ারকন্ডিশনারের তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে না রাখা এবং পিক আওয়ারে এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার না করার প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
সরকার কৃষি জমিতে সেচ ব্যবস্থাপনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যত সরবরাহ নিশ্চিত করতে সেচ মৌসুমে যে সময় নির্ধারণ (রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা) করেছে এবং অফ পিক সময়ে শহরে লোডশেডের মাধ্যমে সেচ পাম্পে বিদু্যত সরবরাহ অব্যাহত রাখার সিদ্ধানত্ম গ্রহণ_ এ দুটো ব্যাপারে কোন বিতর্কে না যাওয়াই ভাল। কারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ এবং খাদ্যে স্বনির্ভরতার জন্য সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন না জানালে দেশ হয়ে উঠবে পরনির্ভরশীল, জাতিকে হারাতে হবে আত্মমর্যাদা।
বিদু্যত খাতের সিস্টেমলস বর্তমান অর্থ বছরে শতকরা ১৪ দশমিক ৬, যা এক দশক আগে শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি ছিল_ এটা কতর্ৃপরে জন্য কিছুটা প্রশংসাজনক। পুরো প্রশংসা তখনই প্রাপ্য যখন সিস্টেমলস থাকবে না। এ ছাড়া সরকারের উদ্বোধনের শ্বেতপাথর বড় কথা নয়, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাটিকে সক্রিয় রাখাটাই অধিকতর শ্রেয়। সরকারের উদ্যোগকে বাসত্মবায়িত দেখতে পারলে জাতি বেশি খুশি হয়, অনত্মত এ মুহূর্তে বিদু্যত উৎপাদন ও বিতরণে সমীকরণের েেত্র তা জরম্নরী।
আরেকটি ব্যাপার লণীয়, বর্তমানে উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে বিদু্যত বিক্রয়ের কারণে প্রতি ইউনিটের জন্য বিদু্যত উন্নয়ন বোর্ড গড়ে ০.২৯ টাকা লোকসান দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠান লোকসানী খাতে চলে যাক, এটা সচেতন নাগরিক চায় না। তবে গ্রাহকদের সহনীয় যাতে হয় সে জন্য ধাপে ধাপে বিদু্যতের বিক্রয়মূল্য বৃদ্ধি করা যুক্তিসঙ্গত।
বিদু্যতখাতে সরকারের এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে : বিদু্যত ব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন; পিক আওয়ারে বিদু্যত চাহিদা পূরণ; লো-ভোল্টেজ সমস্যা দূরীকরণ এবং কারিগরি লস কমানো; অধিকসংখ্যক লোককে বিদু্যত ব্যবস্থার আওতায় আনা। সরকারের এসব উদ্দেশ্য যথাযথভাবে সফল হোক, এ প্রত্যাশায় জাতি আবারও অপেমাণ।

No comments

Powered by Blogger.