৪০ ধরনের অনিয়মে বড় ঝুঁকিতে সোনালী ব্যাংক by আবুল কাশেম

যত ধরনের অনিয়ম করা যায়, সবই করছে সোনালী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামপ্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণ দেওয়া ও আদায়ের ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৪০ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন।
এর ফলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংকটি এবং এই ঝুঁকিব্যবস্থাপনায়ও ব্যাংকটির গতি খুবই মন্থর। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও প্রায় নেই। এসব কারণেই হলমার্কের মতো আর্থিক অনিয়ম সংঘটন সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ না করেই ঋণ দিতেও কার্পণ্য করেনি সোনালী ব্যাংক। ঋণ দেওয়া হয়েছে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়। ব্যাংকের কোনো পরিচালক বা তাঁর আত্মীয়কে ঋণ দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও সরকারদলীয় সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী সোনালী ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালে তাঁর বাবা মো. আবদুল হামিদ মিয়ার মালিকানাধীন এআরএম এন্টারপ্রাইজ ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ৭৫ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছে। নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ঋণ দিয়েছে তামাক চাষ ও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনেও। আদালতের স্থগিতাদেশ লঙ্ঘন করে ঋণ হিসাব শ্রেণীকরণ যেমন করা হয়েছে, তেমনি পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন করা হয়েছে বিশ্রেণীকরণ। এমনকি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে শাখা ব্যবস্থাপকদের।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় সোনালী ব্যাংক যে মুনাফার ঘোষণা দিচ্ছে, তাতেও রয়েছে বড় ধরনের কারসাজি। গত মার্চ পর্যন্ত হিসাবে সোনালী ব্যাংক ১৫৯৭ কোটি টাকা মুনাফা দেখালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মুনাফা তো নেই-ই, উল্টো লোকসান হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতির পাশাপাশি স্বেচ্ছাচারী হওয়ার বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যংক। এ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির অডিট কমিটি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদ থেকে নেওয়া অডিট কমিটির সদস্যরা অনভিজ্ঞ থাকায় ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর তাঁদের নির্ভরতা বাড়ছে। এই সুযোগ নিয়েই কর্মকর্তারা নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। ব্যাংকের ব্যবসা দক্ষ ও নিরাপদভাবে নিশ্চিত করার জন্য পরিচালনা পর্ষদ, অডিট কমিটি, এক্সিকিউটিভ কমিটিসহ আরো অনেক কমিটি রয়েছে। তবে এসব কমিটি যথাযথভাবে ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
'ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও অডিট কমিটির গত এক বছরের যাবতীয় সভার কার্যবিবরণী পরীক্ষা করে দেখা যায়, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণগত দুর্বলতার ভয়াবহতা অনুধাবন করে তা দূরীকরণের ব্যাপারে কখনোই খুব কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি'- সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও অডিট কমিটি সম্পর্কে এমনই মূল্যায়ন বাংলাদেশ ব্যাংকের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আবুল মুনসুর আহমেদ স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. আসলাম আলমের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়। তবে ড. আসলাম আলম ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত- দুজনই বিদেশে থাকায় এসব বিষয়ে তাঁদের কারো সঙ্গেই কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে সোনালী ব্যাংকের অন্য ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সোনালী ব্যাংক এখন ভাবমূর্তি সংকটের মধ্যে পড়েছে। তাই গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সোনালী ব্যাংকের ঘোষিত মুনাফা যাচাই করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত ৩১ মার্চের সাময়িক হিসাবে ব্যাংকটির মোট মুনাফা দেখানো হয়েছে ১৫৯৭ কোটি টাকা। কিন্তু নিজস্ব হিসাব মোতাবেক ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে সংস্থান চার হাজার ১১৪ কোটি, বিনিয়োগের বিপরীতে সংস্থান ১৩ কোটি ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে সংস্থান ৩২৬ কোটি টাকা ওই মুনাফা থেকে বাদ দিলে লাভের পরিবর্তে লোকসান হতো দুই হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, সোনালী ব্যাংকের ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে সংস্থান ছয় হাজার ৫৮৭ কোটি, বিনিয়োগের বিপরীতে সংস্থান ১৩ কোটি, আন্তশাখা হিসাবের অসমন্বিত ডেবিটভুক্তির বিপরীতে সংস্থান চার হাজার ২৩৪ কোটি এবং অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে সংস্থান ৬২১ কোটি টাকা। ব্যাংকটির দেখানো ১৫৯৭ কোটি টাকা মুনাফা থেকে এসব অর্থ বাদ দিলে মুনাফার পরিবর্তে এর লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক ও হলমার্ক গ্রুপের মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার বড় কেলেঙ্কারি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রূপসী বাংলা করপোরেশন শাখা মোট আমানতের অনেক বেশি নগদ অর্থ ঋণ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি অর্থ শাখা নিয়েছে চেস্ট অফিস ও ক্লিয়ারিং এজেন্ট শাখা তথা লোকাল অফিস থেকে নগদ বা ক্লিয়ারিং হিসাবের মাধ্যমে, যা পরে রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়েছে। অন্যদিকে যেহেতু একসেপট্যান্স লায়াবিলিটিজ দেওয়ার ক্ষেত্রে শাখা ব্যবস্থাপনার ওপর কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ নেই, সেহেতু শাখার কর্মকর্তারা তাঁদের ইচ্ছামতো একসেপট্যান্স দিয়েছেন। এর বিপরীতে হলমার্ক অন্যান্য ব্যাংক থেকে আইবিপির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উঠিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।'
ঋণদানের ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকে ওয়েবভিত্তিক এমআইএস সফটওয়্যারও পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে কোনো একটি অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার বেশ পরে তা ধরা পড়ছে। এ কারণে ব্যাংকটির অপারেশনাল ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছেই। প্রতিবেদন মতে, ঋণ মঞ্জুরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও শাখা পর্যায়ে মোট ঋণের সীমা নির্ধারিত নেই। ঋণ মঞ্জুরির পর তা মনিটরিং বা ফলো-আপ ও আদায়ের ব্যাপারে তথ্যভিত্তিক রিপোর্টিং ফরমেটও প্রচলন করা হয়নি। ফলে ঋণগুলো প্রধান কার্যালয়ের অফসাইট পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসাও সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদন মতে, বিধিবদ্ধ নগদ জমা সংরক্ষণে ব্যাংকটি প্রায়ই ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকটিকে জরিমানাও দিতে হয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের কর্জের (ধার) পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫২ কোটি টাকা। এই কর্জ করা অর্থের সুদ গুনতে হয়েছে ৫৩৯ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে এই সুদ ৩৪ গুণ বেশি।
তহবিল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শাখার কর্মকর্তাদের অবাধ সুযোগ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি 'ভয়াবহ নিয়ন্ত্রণহীনতা'। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, 'কোনো শাখার চেস্টে নগদ চাহিদাপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে শাখা ব্যবস্থাপকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মতো কোনো নীতি বা চর্চা কোনোটিই নেই সোনালী ব্যাংকে। আর রেমিট্যান্স-সংক্রান্ত লেনদেনগুলোও কোনোরূপ চেক অ্যান্ড ব্যালান্স (যাচাই-বাছাই) ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। একজন শাখা ব্যবস্থাপক তাঁর ইচ্ছামাফিক একসেপট্যান্স লায়াবিলিটি সৃষ্টি, আইবিপি কিনতে পারেন।'

No comments

Powered by Blogger.