হুইপ পেটানো হারুনে মুগ্ধ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-তাঁকে নিবারণ করে হারুন সঠিক কাজটি করেছেন... মারার ঘটনাটিও বিবেচনা করা হয়েছে

কেবল রাষ্ট্রপতি পদক নয়, নিজের কর্মস্থলের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তির প্রশংসার মালাও গলায় পরলেন হুইপ পেটানো সেই পুলিশ কর্মকর্তা। গতকাল মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ সপ্তাহের আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন,
লালবাগের ডিসি হারুনকে পিপিএম পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের চিফ হুইপকে মারার ঘটনাটিও বিবেচনা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, 'তাঁকে (জয়নুল আবদিন ফারুক) নিবারণ করে ডিসি হারুন সঠিক কাজটি করেছেন। তাঁর ওপর দায়িত্ব ছিল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার। এই দায়িত্ব হারুন কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেছেন।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সপ্তাহ-২০১৩-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে 'সাহসিকতা' ও 'কৃতিত্বের' জন্য ৬৭ জনকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পরিয়ে দেন। রাজধানীর লালবাগের আলোচিত ডিসি হারুর-অর-রশিদ সেবায় পিপিএম পদক পেয়েছেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও কনফারেন্স শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ডিসি হারুন-অর-রশিদের রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পাওয়ার ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'সাহসিকতা ও কৃতিত্বের জন্য দুই ধরনের পুলিশ পদক প্রদান করা হয়। বিবেচনার জন্য পুলিশ সদস্যদের ইতিবৃত্ত আমাদের জানানো হয়। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বিবেচনা করে পদক প্রদান করা হয় না। আপনারা বলছেন, বিরোধী দলের চিফ হুইপকে মারার কারণে তাঁকে পদক দেওয়া হয়েছে, এটা ঠিক না। তবে ওই ঘটনাটিও বিবেচনা করা হয়েছে। আপনারা জানেন না যে, ওই ভদ্রলোকটি (জয়নুল আবদিন ফারুক) সেখানে মা-বাবা তুলে গালি দিয়েছিলেন।'
কোন বিবেচনায় ডিসি হারুনকে পদক দেওয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, 'ওই ঘটনাটিও বিবেচনা করা হয়েছে।' জয়নাল আবদিন ফারুকের ঘটনা ২০১১ সালের। হারুনের ২০১২ সালের কৃতিত্ব কী এবং গত ডিসেম্বরে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় হারুনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে- এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেগুলো এড়িয়ে যান।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৬ ও ৭ জুলাই বিএনপির ডাকা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিন মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় পুলিশের বেপরোয়া হামলার শিকার হন বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। পুলিশের লাঠির আঘাতে ফারুকের মাথা ফেটে যায়, শরীরের বিভিন্ন অংশও জখম হয়। এ হামলায় নেতৃত্ব দেন ওই সময় তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনারের দায়িত্বে থাকা হারুন-অর-রশিদ। সঙ্গে ছিলেন সহকারী পুলিশ কমিশনার বিপ্লব সরকার। এ ঘটনায় ওই সময় ব্যাপক সমালোচনা হলেও পরে পদোন্নতি পেয়ে হারুন উপপুলিশ কমিশনার ও বিপ্লব অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার হন।
সর্বশেষ গত ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির দিন পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে শাঁখারীবাজারের দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু কর্মী। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন, ওই সময় ঘটনাস্থলের মাত্র ২০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন লালবাগের ডিসি হারুন। তিনি এগিয়ে গেলে বিশ্বজিতের ওপর হামলাটি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এমনকি হামলার পর বিশ্বজিতকে বাঁচাতেও এগিয়ে যায়নি পুলিশ। পরে অবহেলায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায়ও আলোচনায় উঠে আসেন ডিসি হারুন। ঘটনার পর সন্দেহভাজন হিসেবে চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় আসামি করে হারুনের অধীন কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এর মাধ্যমে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করানোর অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।
এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাচ্চু রাজাকারকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, 'পলাতক বাচ্চু রাজাকার একটি দেশে অবস্থান করছে। ওই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হবে।' বাচ্চু রাজাকার কোন দেশে আছেন তা জানতে চাইলে তিনি সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেন, 'আমরা ইন্টারপোলের সদস্য। ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়েই তাঁকে যখন আনা হবে তখন ওই দেশটির নাম জানতে পারবেন।'
পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর রাজারবাগের টেলিকম সেন্টারে কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সারা দেশ থেকে আসা পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে বক্তব্য দেন। এ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, '১৯৭২ সালের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার দেশে যেমন অপরাধ ছিল সে তুলনায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে এখন অপরাধ কমে গেছে। এ কৃতিত্ব পুলিশ বাহিনীর।'
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ তাঁর বক্তব্যে পুলিশের পরিবহন সদস্যার কথা তুলে ধরলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'পুলিশের গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।'
সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোখলেছুর রহমান দ্রুত পুলিশ অ্যাক্টের সংশোধনী বাস্তবায়নের দাবি জানান। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, 'এটা আলোচনা করে দেখা হবে।' মাদারীপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'মোবাইল কোর্টের ফুটপাতের দোকানের উচ্ছেদের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগান্তির ব্যাপারে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার হাফিজ উদ্দিন অভিবাসীদের সুবিধার্থে বিদেশে দূতাবাসগুলোতে পুলিশ নিয়োগ করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এটা পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ভূমি অধিগ্রহণে সমস্যার কথা তুলে ধরেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আইনে সীমাবদ্ধতা থাকলেও জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ সমস্যা মেটানো সম্ভব।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেনের এক বক্তব্যের সূত্র ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'পুলিশ কনস্টেবলদের আবাসনের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে। নতুন ব্যারাক নির্মাণ এবং থানায় থাকার ব্যবস্থা উন্নত করা হচ্ছে।' এ ছাড়া পুলিশ কর্মকর্তারা এসএসবিতে পুলিশের প্রতিনিধি দেওয়া এবং ট্রাফিক পুলিশের মতো হাইওয়ে পুলিশের ৩০ শতাংশ ভাতা দেওয়ার দাবি জানান। প্রতিটি দাবির ব্যাপারেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী 'বিবেচনা করা হবে' বলে আশ্বাস দেন।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সি কিউ কে মুশতাক আহমেদ, পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.