তাজউদ্দীন পরিবারের নাম ভাঙিয়ে কাজল এত দূর!

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের 'ঘনিষ্ঠ আত্মীয়' পরিচয়টিকে সাইফুল হাকিম মোল্লা ওরফে কাজল মোল্লা ব্যবহার করেছেন পরশ পাথরের মতো। এই সূত্রেই আজ তাঁর এত প্রভাব-প্রতিপত্তি।
এই আত্মীয়তার দোহাই দিয়েই সংগঠনে কোনো পদে না থেকেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তিনি। বর্তমান সংসদ সদস্য তাজউদ্দীনকন্যা সিমিন হোসেন রিমিও তাঁকে পাশে টেনেছেন। ফলে প্রভাব আরো বেড়েছে। ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু করেছেন। আর সে জন্যই বুঝি গৃহকর্মী ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো ঘৃণ্য কাজ করার পরও তিনি বিষয়টিকে পেশিশক্তিবলে থামিয়ে দেওয়ার অনবরত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কাজল মোল্লার বাড়ি কাপাসিয়ার রায়েদ ইউনিয়নের বড়হর গ্রামে। বাবা মৃত হেকিম মোল্লা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৪-৮৯ মেয়াদে অধ্যয়নকালে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসার পর স্থায়ী কোনো পেশায় ছিলেন না। পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকায়। তবে তাঁর বড় একটি পুঁজি ছিল- শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে 'ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা'। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০০০ সালের দিকে ওই পরিচয় ব্যবহার করে 'মম পোলট্রি লিমিটেডের নামে সোনালী ব্যাংক ঢাকা করপোরেট শাখা থেকে দুই কোটি টাকা ঋণ নেন কাজল মোল্লা। কয়েক লাখ টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে নামমাত্র খামার করে বাকি টাকা সরিয়ে ফেলেন। আর ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ না করেই কয়েক বছর আগে পোলট্রি খামারের মালামাল গোপনে বিক্রি করে দেন। সমপ্রতি ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করলে বন্ধক জমি নিলামে ওঠে। জানা গেছে, কয়েক দফা নিলাম ডাকা হলেও জমির দাম ব্যাংকের প্রাপ্য টাকার সমান হচ্ছে না।
সুযোগ সন্ধানী কাজল মোল্লা আত্মীয়তার ওই সূত্রটি সযত্নে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন প্রথম থেকেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ। এ সময় তিনি অবস্থা বুঝে এলাকায় ঘন ঘন যাওয়া-আসা শুরু করেন। চলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙানো। সেই পুরনো আত্মীয়তার বুলি কপচে প্রভাব খাটিয়ে রায়েদ ইউনিয়নের হাইলজোর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির বিদ্যুৎসাহী সদস্য নির্বাচিত হন কাজল মোল্লা। ২০১০ সালে ওই স্কুলের ছাত্র সাইফুল ইসলাম শাওন এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। ফরম ফিলাপের সুযোগের জন্য কাজল মোল্লা শাওনের বাবা আরিফুর রহমান বাতেনের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন। পরে দর কষাকষি করে কাজল মোল্লা ৯০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এ সময় শাওনের চাচা রায়েদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মোতালেব মিয়া প্রতিবাদ করলে কাজল তাকে লাঞ্ছিত করেন।
কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, কাজলের দ্বন্দ্বের জের ধরে কাপাসিয়ায় গত উপনির্বাচনে মোতালেব মিয়ার পরিবার আফসার উদ্দিন আহমেদকে সমর্থন জানায়। এর জের ধরে নির্বাচনের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কাজল মোল্লা প্রকাশ্যে তাঁর ক্যাডার তোফাজ্জল হোসেনকে নির্দেশ দেন মোতালেব মিয়ার দুই পা হাটুর নিচ থেকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার। তারপরও ওই কেন্দ্রে আফসার আহমেদ রিমির চেয়ে বেশি ভোট পেলে বেরিয়ে আসে কাজল মোল্লার হিংস্র চেহারা। নির্বাচনের পরের দিন কাজলের ভাই রায়েদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হীরণ মোল্লার নেতৃত্বে ক্যাডাররা হামলা করে মোতালেব মিয়াসহ পাঁচজনকে আহত করে। হাইলজোর বাজারের আকবর আলীর দোকানেও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। কাজল এখানেই থেমে থাকেননি। রাত ১০টার দিকে হীরণ মোল্লা ও রায়েদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক আহ্বায়ক আল আমিন শেখসহ ক্যাডার সজ্জিত হয়ে কাজল মোল্লা পুলিশ নিয়ে মোতালেব মিয়াকে খুঁজতে তাঁর বাড়িতে হানা দেন।
স্থানীয় নেতারা জানান, কাপাসিয়ার উপনির্বাচনে সিমিন হোসেন রিমি দলীয় মনোনয়ন পেলে আলোচনায় আসেন কাজল মোল্লা। রিমির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় থাকতেন কাজল মোল্লা। চলাফেরা করতেন একই গাড়িতে। রিমির হয়ে নানা কাজকর্ম করতেন। এভাবে দ্রুত দলে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন তিনি। রিমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর দাপট আরো বেড়ে যায়। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রিমির হয়ে যোগাযোগ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শিডিউল, টিআর-কাবিখার তালিকাসহ সংসদে যাওয়া-আসার সময় রিমির সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন এই কাজল। এমপির ঘনিষ্ঠ হওয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও তাঁকে সমঝে চলতেন। আগামী ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে লবিং শুরু করেন। এমপির আত্মীয় হওয়ায় পদ-পদবীসহ নানা সুবিধার জন্য সুবিধাভোগী নেতারাও তাঁকে ঘিরে ধরেন।
সমপ্রতি গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর খবর প্রকাশ পেলে বেরিয়ে আসতে থাকে কাজল মোল্লার নানা অপকীর্তি। কাজলের এসব অপকীর্তি ঢাকতে অপতৎপরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তাঁর দোসর যুবলীগের ক্যাডার আসাদুজ্জামান আসাদ, উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক মহিলা মেম্বার কানিজ ফাতেমা রুহিতা, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক দীপক মজুমদার খোকন, সাবেক এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা আল আমিন শেখ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ইব্রাহীমসহ সরকারি দলের অনেক কথিত নেতা। তবে তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.