বাড়ির নাম থেকে বিপণি বিতান সবকিছুতে ইংরেজীর দাপট- আ মরি বাংলা ভাষা

 ভাষা আন্দোলনের পর ৫৮ বছর, এমনকি স্বাধীনতা অর্জনের ৩৯ বছর পরেও নিছক বুলিতে পরিণত হয়েছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ঘিরে কয়েকটা দিন আবেগ-উচ্ছ্বাসের বহির্প্রকাশ ঘটলেও অধিকাংশ ৰেত্রেই মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অকারণেই চলছে ইংরেজী শব্দের ছড়াছড়ি। সংবিধান, আইন আর সরকারী নির্দেশনার পরেও সর্বেক্ষেত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা হচ্ছে অবহেলিত। গাড়ির নম্বরফলক, বাড়ির নাম, বিপণি বিতানের নামও লেখা হচ্ছে ইংরেজীতে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও আদালতের রায় লেখায় চলছে ইংরেজীরই দাপট। অন্যদিকে আধুনিকতার নামে চলা বাণিজ্যনির্ভর শিৰার দাপটে শিৰাঙ্গন থেকে বিদায় নিচ্ছে বাংলা। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর নামে ইংরেজী, আরবী, উর্দুর দাপ। বাংলা নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়। ৫৪টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭টিতেই নেই বাংলা বিভাগের অসত্মিত্ব।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি বাংলা একাডেমীর এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন মতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বসত্মরে বাংলা ভাষা চালু হবে।' ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেন, 'বাংলা হবে দেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকারী ভাষা। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এরই আলোকে সর্বসত্মরে বাংলা ভাষা বিশেষ করে সরকারী কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য ১৯৮১ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বাংলা ভাষা বাসত্মবায়ন কোষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৯ সালের নবেম্বর মাসে একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কোর এ স্বীকৃতিলাভের পর ২০০০ সালের ৪ ফেব্রম্নয়ারি ইউনেস্কো মহাসচিব কোইচিরো মাতসুয়ারা বিশ্বের ১৮৮ দেশের কাছে চিঠি দিয়ে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালনের আহ্বান জানান। তারপর থেকে বাংলাদেশের মতো সারাবিশ্বে নিজ নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালিত হচ্ছে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু বাসত্মবতা হলো, আনত্মর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও নিজ দেশে নিজ ভাষাভাষী মানুষের কাছে এখন পর্যনত্ম পরিপূর্ণ মর্যাদা পায়নি বাংলা ভাষা। কিছুদিন আগে রাজধানীর কাঁটাবন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ৫০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর একটি নমুনা জরিপ চালিয়েছিল জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের (নিমকো) প্রশিণার্থীরা। এর আগেও এ প্রতিষ্ঠানের শিৰার্থীরা এ ধরনের জরিপ করেছিল। জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৫১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামফলক বা সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। ইংরেজী ভাষায় লেখা নামফলকের সংখ্যা ২৮০টি। বাংলা ও ইংরেজী মিশ্রিত খিচুড়ি টাইপের নামফলক রয়েছে ১৬৯টির। জরিপে আরও দেখা যায়, কাঁটাবন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা ৪২টি জুতার দোকানের মধ্যে মাত্র একটির নামফলক লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। ভাষাসৈনিক, শিৰাবিদসহ সংশিস্নষ্টরা মনে করেন, ষাটের দশকে দেশের প্রায় সব সাইনবোর্ড লেখা হতো বাংলায়। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যনত্ম এ ধারা বজায় ছিল। এখন ইংরেজীতে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড লেখার হিড়িক চলছে। কেউ ইংরেজী শব্দ ব্যবহার না করেও বাংলা বানানে লিখছে ইংরেজী, যেটিকে ব্যঙ্গ করে করে বলা হয় বাংলিশ। এখন বাঙালীর প্রাত্যহিক জীবনে ভাষাচর্চার বিষয়টি উপেতি হচ্ছে। বাড়ির নাম থেকে শুরম্ন করে সবখানে ইংরেজী শব্দের বাহুল্য। 'বাড়ি ভাড়া' কথাটি না লিখে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় 'টু লেট' বলে। বিশ্ববিদ্যালয় না বলে শিার্থী এমনকি সাধারণ মানুষ পর্যনত্ম বলে 'ভার্সিটি।
সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার ব্যাপারে গত বছর উচ্চ আদালতের দেয়া রায়েরও বাসত্মবায়ন নেই দেশে। অবস্থা এমন যে, দেশে নামীদামী অধিকাংশ বিপণি বিতান আর দোকানে ল্য করা গেছে ইংরেজীতে লেখা সাইনবোর্ড। কয়েকটার নাম বাংলা ভাষায় রাখা হলেও তাও লেখা আছে ইংরেজী হরফে। উত্তরার মাসকাট পস্নাজা থেকে শুরম্ন করে ফ্যামিলি নিডস, বিএনএস সব বাণিজ্যিক ভবনের নাম রাখা হয়েছে ইংরেজীতে। ওয়েস্টটেক্স, সেঞ্চুরি, টপ ফ্যাশন, ক্যাটস আই, মনসুন, প্রিটেক্সসহ সব তৈরি পোশাক শোরম্নমের সাইনবোর্ডই ইংরেজীর একতরফা দাপট। খিলেেত রাজধানী উন্নয়ন কতর্ৃপরে নির্মিত বাণিজ্যিক ভবনের নামটিও রাখা হয়েছে 'রাজউক সেন্টার।' ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের সামনে বাংলাদেশ রেলওয়ের প থেকে দু'টি ফলকের একটি লেখা রয়েছে 'হার্টিয়েস্ট ওয়েলকাম বাংলাদেশ রেলওয়ে', অন্যটিতে লেখা 'খোদা হাফেজ বাংলাদেশ রেলওয়ে'। দু'টিই ইংরেজী হরফে লেখা। শহরজুড়ে মোবাইল ফোন কোম্পানির ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজী ভাষা। হাউসিং কোম্পানির বিলবোর্ডের দশা একই। পুরোপুরি বিদেশী শব্দ বা বাংলা-বিদেশী শব্দের মিশেলে নাম রাখা হয়েছে রাজধানীর অসংখ্য দোকানপাট ও বিপণি বিতানের। 'জাতীয় প্রেসকাব'-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে 'ক্যাফে নিউইয়র্ক', 'ক্যাফে বাগদাদ', 'লাবাম্বা', 'ক্যাফে ঝিল' বা 'মালিহা এন্টারপ্রাইজ।' একইভাবে বড় ও নামীদামী বিপণি বিতানের নাম রাখা হয়েছে 'নিউমার্কেট', 'বসুন্ধরা গার্ডেন সিটি', 'কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি', 'গুলশান পস্নাজা', 'আমির কমপেস্নক্স', 'রাজধানী সুপার মার্কেট', 'স্টেডিয়াম মার্কেট', 'মাস্কট পস্নাজা', 'আলপনা পস্নাজা', 'ইস্টার্ন পস্নাজা', 'ইস্টার্ন পস্নাস' বা 'টুইন টাওয়ার।' ডিস্টিলারি রোড, বেইলী রোড, গ্রীন রোড, এলিফ্যান্ট রোডের মতো সড়কেরও নামের অভাব নেই সারাদেশে। তবে এ ইংরেজী নাম আর বাংলা অৰরে ইংরেজী নামের ব্যবহার শহরেই বেশি। আর বাংলাতে প্রায় ঝেড়ে ফেলেই এ অতি ইংরেজীপ্রীতি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা আর ধানম-ি এলাকায়।
একইভাবে চিকিৎসােেত্র চলছে বাংলার সীমিত ব্যবহার। মেডিক্যাল শিৰা, ব্যবস্থাপত্র, পরীৰার রিপোর্টে কেবলই ইংরেজী। চিকিৎসকরা বেশিরভাগ ব্যবস্থাপত্র লিখছেন ইংরেজীতে, ওষুধের নামও লেখা হয় ইংরেজীতে। ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধের নাম বুঝতে না পেরে অন্যের সহায়তা নিতে হয় বাংলা অৰরজ্ঞানসম্পন্ন সাধারণ মানুষকে। না বুঝে ভুলও করেন অনেকে। এদিকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার মাত্র পাঁচ শতাংশের বেশি নয় বলে মনে করেন সংশিস্নষ্টরা। তবে নিম্নআদালতে ব্যবহার অনেক বেশি। আদালতের রায়ে একতরফা দাপট ইংরেজীর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫৪টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭টিতেই নেই বাংলা বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এবং সাইনবোর্ড লেখা ইংরেজীতে। কয়েকটিতে ইংরেজী নাম লিখে তাতে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা হরফ। অন্যদিকে ইংরেজী নামের কিন্ডারগার্টেন আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চলছে ইংরেজী, আরবী, উর্দুর প্রভাব। অনেক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ অদ্ভুুত। রাজধানীর এমন একটি বিদ্যালয়ের নাম 'অক্সব্রিজ স্কুল'। কথা বলে জানা গেল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে 'অক্স' আর ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে 'ব্রিজ' শব্দ নিয়ে এ অদ্ভুত নাম বানানো হয়েছে। তবে ইংরেজী হরফে বাংলা ভাষা লিখে রীতিমতো সমালোচনার জন্ম দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির বিলবোর্ডে ইংরেজী হরফে ব্যবহার করা হয়েছে অদ্ভুত সব বাংলা শব্দ। ইংরেজীতে লেখা হয়েছে ফাটাফাটি, শুধু তুমি, উরাধুরা, এক দেশ এক রেট_ এ রকম অদ্ভুত সব শব্দ।

No comments

Powered by Blogger.