বিমানবন্দরের নাম পাল্টানোর প্রতিবাদে বিরোধী দলের ওয়াকআউট

জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের প্রতিবাদে সংসদ থেকে প্রতীকী ওয়াক আউট করে বিরোধী দল। তবে ওয়াক আউটের ১৭ মিনিট পরেই তারা পুনরায় অধিবেশনে ফিরে আসেন।
নাম পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ইসু্যতে পয়েন্ট অব অর্ডারে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে জমজমাট, প্রাণবনত্ম বিতর্ক হয়েছে। তবে স্পীকারের কঠোর অবস্থানের কারণে মঙ্গলবার কোন পৰই অশালীন, কুরম্নচিপূর্ণ বক্তব্য রাখতে পারেনি। বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সরকারের কোন কিছুই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হবে না। এই নাম পরিবর্তন করে সরকার সংকীর্ণ প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিচয় দিয়েছে। জবাবে আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান বলেন, কোন স্বৈরাচারের নামে কোন স্থাপনার নাম থাকতে পারে না। আদালতের রায়েই প্রমাণ হয়েছে জিয়া ছিল অবৈধ স্বৈরশাসক। জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এরশাদকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে বিএনপি ৰমতায় এসে তাঁর নামের সকল স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেছে। এরশাদ স্বৈরাচার হলে মওদুদ আহমদের নেত্রী খালেদা জিয়া কেন বলেন না, স্বৈরাচার এরশাদের দেয়া ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছেড়ে দিলাম।
নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট বিলম্বে বিকেল সোয়া তিনটায় স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরম্ন হয়। এর আগেই সংসদে যোগ দেয় বিরোধী দল। গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি বিরোধী দলের যোগদানের দিন ছাড়া মঙ্গলবার পর্যনত্ম সংসদে আসেননি বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। দিনের কার্যসূচী অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আনীত ৫টি বিলের সংসদীয় দলের রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়। এর পরই শুরম্ন হয় দু'পৰের মধ্যে জমজমাট বিতর্ক
উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার পর মঙ্গলবার প্রথম সংসদে কথা বলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য রাখার মাঝপথে মহাজোটের সংসদ সদস্যদের প্রতিবাদ, বিএনপির পৰে পাল্টা প্রতিবাদে উত্তপ্ত হতে থাকে অধিবেশন। কঠোরভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে স্পীকার বলেন, বার বার কটূক্তিপূর্ণ বা অসংসদীয় বক্তব্য না রাখার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। কিন্তু উভয়দিক থেকে এটা হওয়া দরকার। কোন দিক থেকেই এমন শব্দের ব্যবহার করা উচিত নয়, করা হলে তা হবে অনভিপ্রেত।
বিতর্কের সূত্রপাত করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জিয়া আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এ সরকারের কোন কিছুই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হবে না। কণ্ঠস্বরে না পারলেও যুক্তিতর্ক ও বুদ্ধি দিয়ে সংসদে তাদের পরাজিত করা হবে। সরকারের দুর্নীতি, ৰমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সকল ইসু্যতে সরকারকে ধরা হবে। নাম পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, এ সরকারই শেষ সরকার নয়। পরবর্তী সরকার এসে সরকারের এই সংকীর্ণ সিদ্ধানত্ম আবারও পাল্টে দিতে পারে। তিনি বলেন, নাম পরিবর্তন করে জিয়ার নাম কোটি কোটি জনগণের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এটা মনে করলে সরকার তবে বোকার স্বর্গে বাস করছে।
ব্যারিস্টার মওদুদ বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে বোমা পাওয়া যাওয়ার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেৰ তদনত্ম এবং খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান। তিনি স্পীকারকে জিয়ার লাশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ সেলিমসহ অন্য সদস্যদের বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানিয়ে বলেন, সাধারণ মানুষও কখনও কারও লাশ নিয়ে কথা বলেন না। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এমন অশালীন মনত্মব্য প্রত্যাশা করা যায় না। সংসদের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে এ ধরনের কুরম্নচিপূর্ণ, কটূক্তি সংসদকে জনগণের কাছে মর্যাদাহীন করে দিচ্ছে। বক্তব্য শেষ হওয়ার পর পরই সংসদ থেকে বিরোধী দল প্রতীকী ওয়াক আউট করে। এ সময় সরকারী দলের সদস্যরা একযোগে প্রতিবাদ জানিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, প্রধানমন্ত্রী সঠিক কথা বলেছেন, সৎসাহস থাকলে ওই মাজারে জিয়ার লাশ আছে তা প্রমাণ করম্নন।
বিনা ইসু্যতে বিরোধী দলের ওয়াক আউট ও ব্যারিস্টার মওদুদের বক্তব্যের জবাব দিতে উঠে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আবদুল মান্নান বলেন, বিরোধী দল সংসদ থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধানত্ম নিয়েই এসেছে। নানা অজুহাত আর উসিলা তৈরি করে সংসদকে অকার্যকর করতে কীভাবে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে সেই পথ তারা খুঁজছে। তিনি বলেন, মানুষের ভোটের প্রতি তোয়াক্কা না করে বিরোধী দল ৰমতায় আসতে ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। তবে বিরোধী দলকে মনে রাখতে হবে, দেশের মানুষ সচেতন, আগামীতে কোন দিন ষড়যন্ত্রের এই পথে আর ৰমতায় আসা যাবে না। ব্যারিস্টার মওদুদ সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর মতো দলবদলের অভিজ্ঞতা অন্য কারোর নেই। আজ জিয়া সম্পর্কে মওদুদ সাহেব যে কথা বলছেন, ঠিক একই কথা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নেতা এরশাদ সম্পর্কে বলেছিলেন। আমরা আশা করি, এটাই যেন ব্যারিস্টার মওদুদের শেষ কথা হয়, আর জায়গা বদলের সুযোগ না পান।
বিরোধী দলের ওয়াক আউটের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খুবই যুক্তিসঙ্গত কারণে বিমানবন্দরের নাম বদলে ফেলা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়েই বলা হয়েছে কোন শ্বৈরশাসকের নামে কোন স্থাপনা থাকবে না। তবে এ বিষয়ে বিরোধী দলের যদি কিছু বলার থাকে তবে তারা আদালতে গিয়ে বলতে পারে, সংসদে নয়। জিয়ার লাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী জিয়ার ভূমিকা নিয়ে বার বার তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে খালেদা জিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও এটা ঠিক জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে আমরা পরাজিত হলে জিয়াসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কী হতো জানি না, তবে খালেদা জিয়ার ভাগ্য খুলে যেত।
আবদুল মান্নান বলেন, একজন সেক্টর কমান্ডারকে যদি চন্দ্রিমা উদ্যানের বিশাল জায়গায় সমাহিত করা হয়, তবে অন্য সেক্টর কমান্ডারদের কী হবে? বাকি সেক্টর কমান্ডারদের বিষয়েও সিদ্ধানত্ম নিতে হবে। এই অবস্থায় জনগণের দিক প্রশ্ন আসতেই পারে, হয় বাকি সেক্টর কমান্ডারদের একইভাবে সমাহিত করতে হবে, না হয় অন্য সেক্টর কমান্ডারদের এখানে সমাহিত করতে দিতে হবে। বিরোধী দলের উদ্দেশে তিনি বলেন, কথায় কথায় আন্দোলনের হুমকি দিয়ে কোন লাভ হবে না। তিনি বলেন, বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মুখ থেকেই আজ বেরিয়ে আসছে শুধু দুর্নীতিই নয়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র, বগুড়ার গোলাবারম্নদ, উদীচী, রমনার বটমূলে বোমা হামলাসহ সকল অপকর্ম হাওয়া ভবনের রিমোট কন্ট্রোলে হয়েছে। তাই অনেক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া এখনও বাকি। অনেক প্রশ্নের জবাবই এখনও পাওয়া যায়নি, এসব প্রশ্নের উত্তর বিরোধী দলকে দিতে হবে।
এ পর্যায়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে একহাত নেন জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আমি একই দলের নেতা ছিলাম। তাঁর পরামর্শেই আর্মি স্টেডিয়ামের নামকরণ 'এরশাদ আর্মি স্টেডিয়াম' করা হয়েছিল। আবার বিএনপিতে যোগ দিয়েই তিনি ওই স্টেডিয়াম থেকে এরশাদের নাম মুছে ফেলেন। জাতীয় পার্টিতে থাকতে উপজেলা পরিষদ গঠন নিয়ে জোরালো ভূমিকা রেখে ডিগবাজির পর উপজেলা তিনি বাতিল করে দিলেন। একইভাবে এরশাদের দেয়া চন্দ্রিমা উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে এই মওদুদ আহমদের দল জিয়া উদ্যান করেছিল। হয়ত কোনদিন অন্য দলে গেলে এই নাম বদলের জন্যও তিনি প্রসত্মাব করবেন।
চুন্নু বলেন, এরশাদের সবকিছু ব্যারিস্টার মওদুদ ও তাঁর নেত্রী মুছে দিয়েছেন। এরশাদকে খালেদা জিয়া স্বৈরাচারও বলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের যে বিশাল বাড়িটি দিলেন, সংসার পরিচালনাসহ ছেলেদের পড়াশোনার জন্য খালেদা জিয়াকে প্রতিমাসে এক লাখ টাকা, গাড়ি-জ্বালানিীদিলেন- এরশাদ স্বৈরাচার হলে খালেদা জিয়া ওই বাড়িসহ দীর্ঘ সময় নেয়া টাকাপয়সা কেন ফেরত দিলেন না, প্রত্যাখ্যান করলেন না? খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, নিজের বেলায় গণতন্ত্র, রীতিনীতি এসবের কোন কিছুই তাঁর মনে থাকে না। ব্যারিস্টার মওদুদরাও বিএনপিতে গিয়ে এসব কথা ভুলে যান। কিন্তু দেশের জনগণের সব কথা মনে থাকে।
এরপর স্পীকার আর কাউকে ফোর না দিয়ে দিনের কার্যসূচী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় প্রবেশ করলে পৌনে এক ঘণ্টার এই জমজমাট ও প্রাণবনত্ম বিতর্কের অবসান হয়।

No comments

Powered by Blogger.