সময় এখন ভিক্টোরিয়ার

বিশ্বটেনিসে একেক সময়ে রাজত্ব করেন এককেজন। এখন সময় এক বেলারুশিয়ান টেনিস তারকার। নাম তার ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা। একসময় মহারানী ভিক্টোরিয়া শাসন করেছেন পুরো বিশ্ব, আর এখন মেয়েদের টেনিস সাম্রাজ্য শাসন করছেন আজারেঙ্কা।
অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের নারী এককে আজ পর্যন্ত কোন এশিয়ান মহিলা খেলোয়াড় শিরোপা করায়ত্ত করতে পারেননি। ফাইনালে ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কাকে হারাতে পারলে সেই কীর্তিই গড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু পারলেন না লি না। মেলবোর্ন পার্কের রড লেভার এ্যারেনায় শনিবার চাইনিজ তারকা ৩০ বছর বয়সী লি না ৪-৬, ৬-৪, ৬-৩ গেমে হেরে যান বর্তমান র‌্যাঙ্কিংসেরা বেলারুশের ২৩ বছর বয়সী ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কার কাছে। এ নিয়ে টানা দু’বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা করায়ত্ত করলেন আজারেঙ্কা। এর আগের আসরের ফাইনালে হারিয়েছিলেন রাশিয়ার মারিয়া শারাপোভাকে। লি নার বিরুদ্ধে ৯ বারের মুখোমুখি লড়াইয়ে এ নিয়ে আজারেঙ্কা জয়ের দেখা পেলেন পঞ্চমবারের মতো। এটা তার ক্যারিয়ারের তৃতীয় গ্র্যান্ডসযাম ফাইনাল (২০১২ ইউএস ওপেনে হারেন যুক্তরাষ্ট্রের সেরেনা উইলিয়ামসের কাছে), ৩৫০তম জয়, ষোড়শ টাইটেল ট্রফি (১৪টি ডব্লিউটিএ, ২টি আইটিএফ) এবং দ্বিতীয় গ্র্যান্ডসযাম শিরোপা। প্রথমটি জিতেছিলেন ২০১২ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেই। সেবার তার প্রতিপক্ষ ছিলেন রাশিয়ার মারিয়া শারাপোভা। পক্ষান্তরে লি নারও এটা তৃতীয় গ্র্যান্ডসযাম ফাইনাল (জেতেন ২০১১ ফ্রেঞ্চ ওপেনে ইতালির ফ্রান্সেস্কা শিয়াভোনেকে হারিয়ে), ১৬৮তম ম্যাচে হার, ষোড়শ ডব্লিউটিএ ফাইনালে নবম হার। ২০১১ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের আসরে ফাইনাল খেলেছিলেন লি। কিন্তু সেবার ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। হেরে গিয়েছিলেন বেলজিক টেনিস নক্ষত্র কিম ক্লিস্টার্সের কাছে। এবার হারলেন বেলারুশিয়ান আজারেঙ্কার কাছে। ফাইনালে দুই তারকাই খেলেন চোট নিয়ে। লির সমস্যা ছিল এ্যাঙ্কেলে। আর আজারেঙ্কার হাঁটুতে। খেলার একপর্যায়ে মেডিকেল ট্রিটমেন্টের জন্য কোর্ট ছেড়ে বের হয়েও যেতে হয় আজারেঙ্কাকে। প্রথম গেম হেরে গেলেও পরের দুই গেম জিতে ম্যাচ ও ট্রফি জিতে নেন আজারেঙ্কা। যদিও ফাইনালে দর্শক সমর্থন বেশি ছিল লির দিকেই। কিন্তু ম্যাচে ৩২টি ‘এরর’ করে শিরোপা জিততে পর্যবসিত হন ব্যর্থতায়। ‘আমি সত্যিকার অর্থেই শিরোপা জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত। ফাইনালে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব।’ নিজের ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য নিজের স্বামীকে কয়েকদিন আগেই কোচের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া লি (এখন তার কোচ আরেক সাবেক বেলজিক তারকা জাস্টিন হেনিনের কোচ কার্লোস রদ্রিগুয়েজ) একথা বলেছিলেন সেমিফাইনালে শারাপোভাকে হারানোর পর। কিন্তু ফাইনালে সে কথাকে কাজে রূপ দিতে পারেননি তিনি। যদিও অস্ট্রেলিয়ান ওপেন শুরুর আগে বেশ ভাল প্রস্তুতিই নিয়েছিলেন লি না। নিজ দেশ চীনে অনুষ্ঠিত শেনঝেন ওপেনে শীর্ষ বাছাই ছিলেন তিনি। ‘লোকাল ফেবারিট’ হিসেবে লি ফাইনালে চেক প্রতিপক্ষ ক্লারা জাকাপালোভাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১২ সালটা লির জন্য ছিল হতাশার।
চারটি আসরের ফাইনালে উঠে চ্যাম্পিয়ন হন কেবল একটিতে (সিনসিনাতি ওপেন)। আর হেরে যান সিডনি, রোম এবং মন্ট্রিল ওপেনে। সাদা পোশাকে ঠিক যেন সাদা পরী। ট্রফি হাতে এলোচুলে ফটোসেশনের সময় সবার চোখ আটকে যাচ্ছিল আজারেঙ্কার ওপর। আর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ট্রফিটা দেখে তো চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়! ট্রফির গায়ে বিজয়ীর সঙ্গে খেলোয়াড়ের দেশের নাম লেখাটা রীতি টেনিসের সবচেয়ে দামী এ টুর্নামেন্টের। কিন্তু আজারেঙ্কার নাম ঠিকঠাক থাকলেও দেশের জায়গায় সংক্ষেপে লেখা বিইএল। একই নাম লেখা ছিল কিম ক্লিস্টার্সের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ট্রফিতেও। তাহলে কি ভুল করে বেলারুশের বদলে আজারেঙ্কার দেশের নাম বেলজিয়াম লিখে ফেলল আয়োজকরা? কেননা বেলারুশের সংক্ষিপ্ত নাম বিএলআর কোনভাবেই বিইএল নয়। দুটো দেশের নামের শুরুতেই ইংরেজী তিনটি অক্ষর বিইএল থাকাতেই হয়তো হয়ে গেছে ভুলটা। আয়োজকরা ভুল করতে পারেন, কিন্তু শিরোপা জিততে মোটেও ভুল করেননি আজারেঙ্কা। র‌্যাঙ্কিং সেরার আসনটা গত বছর হাতছাড়া হয়েছিল বেলারুশিয়ান ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কার। তবে অল্প ক’দিন পরেই জিতেও আবারও শীর্ষাসন ফিরে পান তিনি। ওই বছর ৯ টুর্নামেন্টের ফাইনালে উন্নীত হন আজারেঙ্কা। চ্যাম্পিয়ন হন ৬টিতে (সিডনি, অস্ট্রেলিয়ান, দোহা, ইন্ডিয়ান ওয়েলস, বেজিং ও লিঞ্জ ওপেন)। স্টুটগার্ট, মাদ্রিদ ও ইউএস ওপেনের শিরোপা হাতছাড়া করেন।
আজারেঙ্কার খেলার স্টাইল সবসময়ই আলোচিত। বলা হয়ে থাকে, সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে আগ্রাসী যেসব বেসলাইনার আছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা হচ্ছেন আজারেঙ্কা। তাছাড়া তাঁর ড্রাইভ ভলিও নজরকাড়া। তবে সমস্যা হচ্ছে সার্ভে দুর্বল তিনি। কোর্টে তাঁর নড়াচড়াও সেরেনা-শারাপোভাদের মতো ততটা দ্রুতগতির নয়। ফোরহ্যান্ড শটেও তেমন দৃঢ়তা নেই। তবে এ সমস্যা অনেক গ্রেট খেলোয়াড়েরই ছিল এবং আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বয়স আজারেঙ্কার অনুকূলে। অনেক টেনিস বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজের মধ্যে যেসব দুর্বল দিকগুলো আছে, সেগুলো যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠে বিশ্বসেরার তকমা ধরে রাখার মতো যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে তাঁর মধ্যে।
ছোটবেলায় টেনিসের প্রতি আগ্রহ দেখে মা-বাবা তাঁকে এ খেলাটি খেলতে বাধা দেননি, বরং যুগিয়েছেন উৎসাহ। সে উৎসাহ নিয়েই এখন টেনিস কোর্ট মাতিয়ে যাচ্ছেন আজারেঙ্কা। আগামী দিনগুলোতে র‌্যাকেট হাতে সফল হয়ে শীর্ষস্থানটি অক্ষুণœ রাখবেন, এটাই তাঁর অগুণিত ভক্ত-সমর্থক-অনুরাগীর নিগূঢ় প্রত্যাশা। সাফল্যের অভিমুখে কিংবা অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে ক্লান্তিহীন আজারেঙ্কা এগিয়ে যেতে চান আরও বহুদূর। র‌্যাঙ্কিংসেরা হওয়া ও ক্যারিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ডসø্যাম জয়ের পর থেকে তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদটা যেমন হয়েছে উর্ধমুখী, তেমনি ব্যক্তিগত নৈপুণ্যও যেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে আজারেঙ্কার। এখন দেখার বিষয় এ সাফল্য কতদিন ধরে রাখতে পারেন তিনি। ভিক্টরি। এ শব্দটি বলার কারণ, তার নামের মধ্যেই আছে শব্দটি। ভিক্টোরিয়া। ভিক্টোরিয়া আজারঙ্কা। ৬ ফুট উচ্চতা ও ডান-হাতি এ প্লেয়ারটি এ পর্যন্ত টেনিস খেলে আয় করেছেন নিহায়ত কম নয়- ১ কোটি ৬৮ লাখ ৯২ হাজার ৯৯২ ডলার! এখন নিবাস গড়েছেন মোনাকোর মন্টে কার্লোয়। লির মতো সেমিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ছোট সেরেনা’ সেøায়ানের বিরুদ্ধে খেলার সময় হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েছিলেন আজারেঙ্কা। তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে খেলা চালিয়ে যান তিনি। এখন দেখার বিষয়, আগামী দিনগুলোতে এ উড়ন্ত ফর্ম কতটা ধরে রাখতে পারেন আজারেঙ্কা।

No comments

Powered by Blogger.