অপরূপ সৈকত_ বড় বিনিয়োগের হাতছানি, চাই পরিকল্পনা- পর্যটন নগরী কক্সবাজার-৩

 'ইনানী বীচের পাশের একটি জমি দেখিয়ে ছেলেটি বলল, তিন বছর আগেও এখানে এক বিঘা জমির দাম ছিল ২০ লাখ টাকা। এখন এক কাঠা জমিই বিক্রি হয় ১০ লাখ টাকায়।
আর যে জমি থেকে সমুদ্র সৈকতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, সেখানের জমির দাম আরও বেশি।' বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য মাত্র কয়েক বছরে কক্সবাজারের জমির দাম ১০ গুণ বেড়ে গেছে। বিনিয়োগের এমন অপার সম্ভাবনাময় কক্সবাজারকে ঘিরে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে বাধাগ্রসত্ম হচ্ছেন। ঢাকার এক বড় ব্যবসায়ী তিন বছর আগে কক্সবাজারে জমি কিনেও তা ফেলে রেখেছিলেন। চলতি বছর নিজ উদ্যোগেই সে জমিতে স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও পদে পদে বাধাগ্রসত্ম হচ্ছেন। ৰোভ নিয়ে জানালেন, বিনিয়োগের ৰেত্রে তিনি সিদ্ধানত্মহীনতায় ভুগছেন। ভাবতেই অবাক লাগে একটি পর্যটন নগরীতে স্থাপনা নিমর্াণেও পরিকল্পনা নেই। নেই কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য কোন পরিবেশ তৈরি করা হয়নি।
এ বিষয়ে বেসমারকি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল ৰোভ প্রকাশ করে জনকণ্ঠকে বলেন, একটি পর্যটন নগরী যুগের পর যুগ যেভাবে পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠছে তা বিশ্বে নজিরবিহীন। আমরা স্থায়ী কমিটির পৰ থেকে কক্সবাজারকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছি। জোর দেয়া হয়েছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এখনই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না তুললে কক্সবাজার একটি বড় ডাস্টবিনে পরিণত হবে। বিনিয়োগকারীদেরও ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজারে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে হোটেল মোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ছোটখাট হোটেল মোটেলের নেই কোন পার্কিং ব্যবস্থা। কলাতলী থেকে হোটেল মোটেল জোন থেকে শুরম্ন করে লাবনী পয়েন্টের পর পর্যনত্ম পার্কিং ছাড়া হোটেল মোটেলের কারণে ৩০ ফুট চওড়া রাসত্মাটি দিনকে দিনকে দিন সরম্ন হয়ে যাচ্ছে। রাসত্মার পাশেই দূরপালস্নার বাসের কাউন্টার। কক্সবাজারে ৪শ' হোটেল মোটেল থাকলেও নিবন্ধন আছে মাত্র ৬০টির। সেসব হোটেলের জন্য কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। সকলেই নিজের মতো করে বর্জ্য ফেলছে। সম্প্রতি হোটেল মালিকরা পৌর মেয়রকে এ নিয়ে আলটিমেটামও দিয়েছে। সব দেখেশুনে বড় বিনিয়োগকারীরা হতাশ। তাদের পরার্মশ, যত দ্রম্নত সম্ভব এসব অব্যবস্থাপনা বন্ধ করে উন্নয়ন কাজ শুরম্ন হোক। বিনিয়োগ ও বিদেশী পর্যটক বাড়াতে ৫০টি দেশকে কক্সবাজারে ৫০ একর জমি লিজ দেয়া হোক।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পৌসসভার মেয়র সরওয়ার কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বড় ধরনের সহায়তা প্রয়োজন। তেমন বাজেট পৌরসভার নেই। পৌরসভার উন্নয়নের জন্য সরকার ২৭ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রেখেছে, যা দিয়ে যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। হোটেল মোটেল মালিকদের আলটিমেটাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাজেট না থাকলে আলটিমেটামে কোন লাভ হবে না। আর এ ব্যাপারে তাদের নিজেদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা কেউ নিয়মিত পৌরকর পরিশোধ করেন না। তিনি বলেন, কক্সবাজারকে ঘিরে কখনই বড় ধরনের পরিকল্পনা করা হয়নি। এখন অনেক বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে কাজ করতে না পারলে এক সময় তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সরকার একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আপাতত উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আশা করি, বিনিয়োগকারীরা র্ধৈয হারাবেন না। তিনি বলেন, আমরা চাই অত্যনত্ম পরিকল্পিতভাবেই কার্যক্রম চালু থাকুক। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কক্সবাজারে বিনিয়োগ করার যে আগ্রহ রয়েছে তা ধরে রাখতে হবে।
এদিকে স্থানীয়দের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে জমি কিনে নেয়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর দাবি যত দ্রম্নত সম্ভব পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শেষ করে তাদের স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ দেয়া হোক। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারে বিনিয়োগকারী বড় প্রতিষ্ঠান গ্রীন ডেল্টা হাউজিং কোম্পানির চেয়ারম্যান নুরম্নল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরাও চাই পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠুক কক্সবাজার। তা না হলে এখানে লোক কেন বিনিয়োগ করবে। আর বিনিয়োগ না হলে উন্নয়নও সম্ভব নয়। শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি বিবেচনা করা হয় তাও আমরা জোর গলায় বলতে পারি পর্যটন আর্কষণে এবং ভবিষ্যতে এ স্থানটিকে বিশ্বের অন্যতম বড় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কাজটি আমরাই করতে যাচ্ছি। এখানে আমাদের শত শত কোটি টাকার প্রকল্প। প্রবাসীরা যাদের টাকা বড় ভাই বা পরিবারের অন্যদের নামে পাঠানোর কারণে অপব্যবহার হয়েছে, তারা এসব স্টুডিও টাইপড বা সার্ভিসড এ্যাপার্টমেন্ট কিনে একদিকে মালিক হচ্ছেন, অন্যদিকে বছরের অন্য সময়গুলোতে রম্নম ভাড়া দিয়ে মাসে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা উপার্জন করার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা ইনানী থেকে শুরম্ন করে এমন জায়গায় এ্যাপার্টমেন্ট করছি যেখানে লোকজন থাকার জায়গার অভাবে দিনে দিনে ফিরে যায়। অনেকের সেখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য নিয়েও কোন ধারণা নেই। ভবন নির্মাণের ফলে পর্যটন স্থানেরও প্রসার ঘটছে বলে মনে করি আমি। বহুতল ভবন নির্মাণের ফলে পাহাড় ঢেকে যাবে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে সারি সারি ভবন করলে তো পাহাড় ঢাকবেই। সেজন্যই তো আমরা একটি কার্যকর মাস্টারপস্ন্যানের অপেৰায় আছি। তিনি জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কলাতলীর মেরিন ড্রাইভ রোডে ৫৫০ থেকে ১১শ' বর্গফুটের 'সমুদ্র বিলাস' নামের পাঁচতারকা হোটেল মানের সার্ভিসড এ্যাপার্টমেন্ট তৈরির কাজ শুরম্ন করেছে। কাজ চলছে সী বীচ সংলগ্ন তিনতারকা মানের 'গোল্ডেন হিল', সার্কিট হাউজ রোডের বাহারছড়ায় এ্যাপার্টমেন্ট 'ওশিন ড্রিম' এবং 'ইয়াসির ভিলা' তৈরির। এছাড়া ইনানী বীচে পাঁচ তারকা মানের এবং হিমছড়িতে তিন তারকা মানের সার্ভিসড এ্যাপার্টমেন্ট তৈরির প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন্ন দেশের পর্যর্টন এলাকার অবকাঠামোর আদলে আমাদের এখানেও একই ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ ওই সব দেশে অত্যনত্ম সুপরিকল্পিতভাবে তারা গড়ে তুলেছে প্রয়োজনীয় স্থাপনা। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। নান্দনিকতায়ও প্রশংসিত হয়েছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কোরিয়া এবং বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাতে বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন তৈরি করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছে। তাদের অবকাঠামোগুলো কিভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং তারা কিভাবে স্বাস্থ্যসম্মত, গুণগতমান ও পরিবেশ রা করে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে দেশের উন্নতি করেছে তা আমাদের অনুসরণ করা উচিত।
হোটেল মোটেল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাশেম শিকদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ তিনি পর্যটন বিকাশে কক্সবাজারে বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে একটি বৈঠক করবেন। বিনিয়োগ বাড়াতে ৫০টি দেশকে ৫০ একর জমি লিজ দীর্ঘ মেয়াদে লিজ দেয়ার পদৰেপ নেবেন। এতে করে তাদের বিনিয়োগের কারণেই সেসব দেশের পর্যটকরা কক্সবাজারে আসবেন। এতে আমাদের আয় হবে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা।

No comments

Powered by Blogger.