জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সরকারের দতা- এএমএম শওকত আলী

সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। এ আলোচনা কোপেনহেগেন সম্মেলন পরবর্তী সময়ে আরও গতি লাভ করেছে। গত বছর এ সম্মেলনের পূর্বেও আলোচনা হয়েছে।
সভা, সেমিনার, কর্মশালা হয়েছে অনেক। বিগত কয়েক বছর ধরে যে সমস্ত আলোচনা হয়েছে তার মূল ল্য ছিল বিশ্বব্যাপী এ বিষয়ে জনসেচতনতা সৃষ্টি করা। এরই ধারাবাহিকতায় উন্নত দেশসমূহকে জলবায়ুর তিকর প্রভাব লাঘবের জন্য সৃষ্ট জনমতের চাপে তারা সম্ভাব্য তিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থ সাহায্য দিতে রাজি হয়। কোপেনহেগেন সম্মেলনে মূল বিষয় ছিল তিপূরণের ব্যবস্থা করা। এ সম্মেলন নিয়ে কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও প্রকাশিত সংবাদ মতে তিপূরণের অঙ্ক নির্ধারিত হয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তবে নির্ধারিত সাহায্য তিগ্রস্ত সবদেশই পাবে।
বিগত জানুয়ারি ২ তারিখে ঢাকায় এ সম্পর্কে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সেমিনারে বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরাসহ একজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। বিশেষজ্ঞদের প্রধান বক্তব্য ছিল জলবায়ু তহবিল খরচে সরকারের দতা বাড়াতে হবে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে প্রচুর অর্থ সাহায্য আসবে সে সাহায্য বাংলাদেশ ব্যবহার করতে প্রস্তুত কিনা? এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ দুইটি আশু পদপে গ্রহণের প্রতি আলোকপাত করেন। এক. এ বিষয়ে দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ করা। দুই. বিদেশী অর্থ সাহায্য ব্যবহার করার নীতিমালা প্রণয়ন। অন্য একজন বিশেষজ্ঞও সরকারকে দতার সাথে কার্যক্রম গ্রহণ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। উপস্থিত মন্ত্রী সরকারের দতার অভাবের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ইতোমধ্যে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু যে বিশেষজ্ঞ দতার অভাবের বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন তিনি মন্ত্রীর বক্তব্যে আশ্বস্ত না হয়ে বলেন যে, দতার অভাব রয়েই গেছে।
যে যাই বলুক না কেন, সরকারের দতার অভাবের বিষয়টি নতুন কোন সমস্যা নয়। সব সরকারের আমলেই কমবেশি এ সমস্যার বিষয়ে মিডিয়ায় আলোকপাত করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দতার তীব্র অভাব সম্পর্কে খোদ প্রধানমন্ত্রী ও সচিবসহ মন্ত্রীদের এ বিষয়ে অধিকতর সচেতন হওয়ার পরামর্শ একাধিকবার দিয়েছেন এবং সর্বশেষ সাবধান বাণীও উচ্চারণ করেছেন। তিনি এ বিষয়ে এটাও মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে, এক বছর শিানবিসী কাল যথেষ্ট। অর্থাৎ অদতার অব্যাহত ধারা তিনি আর সহ্য করতে রাজি নন। তিনি অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে জলবায়ু সংক্রান্ত মোকাবেলার বিষয়ে এ কথাগুলো বলেননি। সার্বিক অবস্থা বিচার বিশ্লেষণ করেই তিনি তাঁর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে সার্বিকভাবে অদতা বিরাজমান থাকলে জলবায়ু মোকাবেলায় সম্ভাব্য পদপে বাস্তবায়নের জন্য এ বিষয়ে যে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে সে কথা নিঃসন্দেহে বলা সম্ভব।
সাত শ' কোটি টাকার যে তহবিলের বিষয়ে মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা দিয়েই প্রাথমিকভাবে ২০০৮ সালে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে অর্থ বিভাগ গঠন করেছিল। সে তহবিলই বর্তমানে দ্বিগুণেরও অধিক হয়েছে। খরচ হয়েছে কত তা জনগণের কাছে অজ্ঞাত। এ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেলে চলমান অদতার বিষয়টি অধিকতর স্বচ্ছ হতো। এ বিষয়ে সরকার যদি আশু পদপে গ্রহণ করে তাহলে ভাল হয়। ২০০৮ সালে নিজস্ব অর্থায়নে যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল সে সময়েও সংেেপ হলেও কয়েকটি খাতকে চিহ্নিত করে সে সমস্ত খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রকল্প প্রণয়নের অনুরোধ করা হয়েছিল। এ বিষয়েও কয়টি মন্ত্রণালয় কত সংখ্যক প্রকল্প ইতোমধ্যে দাখিল করেছে এবং করে থাকলে তার মধ্যে কত কোন্ সময় অনুমোদিত হয়েছে এবং বাস্তবায়নের অগ্রগতি কত তা জানা প্রয়োজন। কারণ এ প্রক্রিয়ায় লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকেই ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গঠিত তহবিল কোন খাতে, কোন ধরনের প্রকল্পে কত টাকা ব্যয় হবে সে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্ণয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বিগত ২০০৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঐ বছরের যে একটি দিন বিশ্বব্যাপী পালন করে, সে দিনটির প্রধান বিষয়বস্তুই ছিল জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য। তবে অগ্রাধিকারের বিষয়ে কৃষি ও খাদ্য খাতসহ অবকাঠামো খাতও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সিডরের পরবর্তী সময়ে আইলার আঘাতে দণিাঞ্চলের অবকাঠামোসহ জনজীবন যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে সে বিষয়ের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশ্ন করা যায় যে, এ বিপর্যস্ত জনজীবনকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে আর কতদিন প্রয়োজন হবে তা এখনও অজানা। তবে কোন কাজই যে হচ্ছে না এমনটিও নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কাজের গতি ও গুণগতমান কতটুকু। গতি যে শম্বুকগতি এবং গুণগত মানের বিষয়টিও যে কিছু েেত্র প্রশ্নবিদ্ধ তা মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদেই প্রতীয়মান হয়।
সরকারের অদতার বিষয় সরকারবহির্ভূত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করলেই যে সরকারী পর্যায়ে তার প্রতিবাদ তাৎণিকভাবে করলে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে প্রকৃত বিষয়টি তিমিরেই থেকে যায়। এ যুক্তি বেসরকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্যও প্রযোজ্য। এ কারণে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষণমূলক ও গঠনমূলক সমালোচনা। পারস্পরিক সহনশীলতা ও গঠনমূলক সমালোচনার ভিত্তিতেই সব রকমের সমস্যার মোকাবেলায় যথাযোগ্য সমাধান সম্ভব। সরকারী এবং বেসরকারী উভয়পই এ বিষয়ে অধিকতর বিচণতা দৃশ্যমান করলে দেশের জন্য মঙ্গল হবে।
যে বিশেষজ্ঞ প্রস্তুতিসহ তহবিল ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন সে বিষয়ে সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে কার্যকরী পদপে গ্রহণ করা। এ পদেেপর জন্য ২০০৮ সালে যে কাঠামো প্রণীত হয়েছিল তা যদি সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তা নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে খাতওয়ারী অগ্রাধিকারও নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সেমিনারে উপস্থিত মন্ত্রীর প্রকাশিত সংবাদে একটি উক্তি ছিল 'অনেকে হয়ত অপো করে আছে কখন তহবিল আসবে, প্রচুর কর্মশালা, সেমিনার হবে।' এ উক্তিটি অনেকে কটা মনে করে মনঃুণ্ন হতে পারেন।
প্রকৃত প েবক্তব্যটির মূল বিষয় হলো যে অর্থ দিয়ে ইতোমধ্যে তহবিল গঠন করা হয়েছে তার সময়োচিত ও সঠিক বাস্তবায়ন শুরু করা। এ বিষয়টি উপো করলে চলবে না। কারণ বিদেশী সাহায্যপুষ্ট তহবিল বা অর্থ সাহায্যের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন একটি জটিল বিষয়। এ বিষয়টি অর্থ যোগানদাতা দেশ ও সংস্থাসমূহের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই করতে হবে। এ বিষয়ে মূল জটিলতা হলো এক এক দেশের ও এক এক সংস্থার প্রদত্ত অর্থ ব্যবহারের নীতিমালা ভিন্নতর। এছাড়া এদের দৃষ্টিভঙ্গী ও মানসিকতার মধ্যেও ভিন্নতা বিদ্যমান। নিজস্ব নীতিমালার ব্যতিক্রম তারা করতে আগ্রহী নয়। সাম্প্রতিককালে সরকার ক্রয় আইন সংশোধনের বিষয়ে এ দৃষ্টিভঙ্গী দৃশ্যমান ছিল। সরকারের 'একলা চল রে' নীতির ফলে বিদু্যত সাশ্রয়ী বাল্ব বিনামূল্যে সময়মতো বিতরণের কর্মসূচীও পিছিয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে এ ধরনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।
সেমিনারে উপস্থিত মন্ত্রী আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করেছিলেন। প্রকাশিত উক্তিটি ছিল 'চাষাবাদে ভূ-গর্ভস্থ পানি ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে আমাদের তি হচ্ছে।' সরকার কৃষি কাজে নদী ও খালের পানি ব্যবহার করতে চায়, আর চায় জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে। প্রথমোক্ত বিষয়টি সর্বজনবিদিত। এ কাজটি করার বিষয়ে যে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাও সরকারের অজানা নয়। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে সম হলে আর্সেনিক দূষণসহ আরও অনেক সমস্যার সমাধান হবে। তবে এ বিষয়ে মূল প্রশ্নটি হলো এ প্রক্রিয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত ও অধিকতর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সেচ যন্ত্রেও মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং সঠিক স্তরে পানি উত্তোলনের জন্য উপযুক্ত সেচ যন্ত্র ব্যবহার করা। এ ল্য অর্জনের জন্য ১৯৮৫ সালে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা অর্ডিন্যান্স নামে একটি আইনও প্রণীত হয়েছিল, কিন্তু দাতা সংস্থারা মনে করল এ আইন প্রয়োগে বেসরকারী উদ্যোগে ব্যাহত হবে। তাদের এ ধরনের দ্বিমত পোষণ করার ফলে তৎকালীন সরকার আইনটি কার্যকর করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পরবর্তীতেও কোন সরকার এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি।
ঐ সময় বিকল্প হিসাবে বিএডিসিকে বলা হয় এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাথে যৌথভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি কর্মসূচী গ্রহণ করা। এ কাজটিও হয়নি। অন্যদিকে সাম্প্রতিককালে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ধান চাষে অধিক পানি ব্যবহার রোধ করার উদ্যোগ। এ উদ্যোগ বিএডিসি ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। অনেক স্থানে বিএডিসিকে খাল খনন করারও দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। সুপরিকল্পিত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে এ ধরনের বহুমুখী প্রচেষ্টা গ্রহণের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারী পর্যায়ে অধিকতর কর্মসূচী প্রণয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়ন।
তবে ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় দুই সেচযন্ত্রের দূরত্ব কত হবে সে বিষয়ে সারা দেশের জন্য উপজেলাভিত্তিক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বিএডিসির শীর্ষ স্থানীয় কিছু প্রকৌশলীর এ নিয়ে কিছু আপত্তি রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি পুনর্পরীা প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে এ দূরত্ব বাস্তবে অনুসৃত হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি নিবিড় পরিবীণ করার কাঠামোগত পদপেও প্রয়োজন।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১০

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.