এলার্জি- পুষ্পরেণু

আমাদের দেশ ঋতু বৈচিত্র্যময় দেশ আর ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে গাছে বিভিন্ন ফুলের আগমন দেখতে ভালই লাগে, এই ভাল লাগা কারও কারও জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ বিশেষ করে যাদের এলার্জিজনিত এ্যাজমার ভেসে আসা পুষ্পরেণু হে ফিভার এবং এ্যাজমার উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে।
পরাগায়নের ঋতু চলতে থাকে কয়েক মাস ধরে ফলে এলার্জি রোগীদের পক্ষে পুষ্পরেণু এড়িয়ে চলা খুব কঠিন তবুও কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে রোগ প্রতিরোধ এবং উপসর্গ থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
পুষ্পরেণূ কী : পুষ্পরেণু শব্দটি এসেছে টংরেনি পোলেন থেকে। পোলেন প্রকৃতপক্ষে গ্রিক শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্র ফুল। উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে পুষ্পরেণুর মাধ্যমে পরাগায়ন একটি প্রয়োজনীয় পদ্ধতি।
* কিছু উদ্ভিদ সামান্য পরিমাণে পুষ্পরেণু উৎপাদন করে এদের ক্ষেত্রে পরাগায়ন ঘটে মূলত বাতাসের মাধ্যমে এসব উদ্ভিদ পুষ্পরেণু উৎপাদন করে অনেক বেশি পরিমাণে। বাতাসের মাধ্যমে পুষ্পরেণু অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়ে। এলার্জির প্রকোপ এই অবস্থান করলেও রোগীরা আক্রান্ত হতে পারে বায়ুবাহিত পুষ্পরেণু দ্বারা।
অনেক আগাছা থেকে পুষ্পরেণু এসে এলার্জি আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়। সেগুলোর মধ্যে আছে-
* পেনিটারি আগাছ- এর অন্য নাম ‘এ্যাজমা আগাছা’। এই আগাছা এসেছে ইতালি থেকে।
* পিটারসনের অভিশাপ - দেখতে প্রচুর ফুল বিশিষ্ট আগাছার জন্মস্থান ইংল্যান্ড।
পুষ্পরেণু থেকে হে ফিভার : হে ফিভার অন্য নাম হচ্ছে সিজনাল এলার্জিক রাইনাইটিস। আগে মনে করা হতো খড় বা পেঘ্রান থেকে এই রোগের উৎপত্তি। এই রোগ দেখা দেয় পুষ্পরেণু শরীরে প্রবেশের শরীরের রোগ প্রতিরোধমূলক শক্তির প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। আক্রান্ত হয় চোখ এবং নাকের বাতাস চলাচলের রাস্তা। উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে অবিরাম নাক দিয়ে পানি পড়া, চুলকানি, নাক বন্ধ হয়ে থাকা, শ্বাস কম, চোখ থেকে পানি ঝরা, কান, গলা এবং মুখের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয় প্রচ- রকম।
হে ফিভার মানুষের আকর্যকর করে! মারাত্মক অসুখ
* দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি ৫ জনের ১ জন এই রোগে আক্রান্ত।
* এর ফলে সাইনাসের প্রদাহ বেড়ে যায়।
* রোগীর প্রচ- ক্লান্তি অনুভব করে। আবার নিদ্রাহীনতায় ভোগে।
* আক্রান্ত শিশুরা স্কুলে যেতে পারে পারে না। বয়স্করাও কর্মস্থলে যেতে পারে না ফলে কর্মদিবস নষ্ট হয়।
* এ্যাজমা রোগীরা হে ফিভারে আক্রান্ত হলে রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।
পুষ্পরেণু এ্যাজমার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয় : হে ফিভার আক্রান্ত রোগী একসময় শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। ফলে ভাবতে থাকেন। যে তিনি এ্যাজমাতে আক্রান্ত হয়েছেন।
ধারণা ভুল! প্রকৃতপক্ষে পুষ্পরেণু এ্যাজমার প্রকোপও বাড়িয়ে দেয়। ছোট ছোট পুষ্পরেণু নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসের অত্যন্ত গভীরে প্রবেশ করে। ফলে উপসর্গ তৈরি হয়। একজন রোগী একই সঙ্গে ্এ্যাজমা এবং হে ফিভারে আক্রান্ত হতে পারেন।
পরাগায়নের ঋতু কয়েক মাস ধরে থাকে : উদ্ভিদের প্রকারভেদে পরাগায়ন ঋতু ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেমন- বড় বৃক্ষে পরাগায়ন হয় শীতের শেষে এবং বসন্তের শুরুতে। ঘাসের পরাগায়ন হয় তার পরে। এবং আগাছা থেকে পরাগায়ন হয় আগস্ট থেকে মে মাস পর্যন্ত। যে অঞ্চলে বাতাস প্রবাহ বাধা কম সেখানে পুষ্পরেণু বেশি হয়।
সঠিক রোগ নির্ণয় করা প্রয়োজন : রোগের খুঁটিনাটি ইতিহাস জানা প্রয়োজন। যেমন- উপসর্গ শুরুর সময় কখন, এলাকার কোন ধরনের গাছপালা বেশি, সেইসঙ্গে এটাও জানতে হবে যে, সাপ্তাহিক ছুটিতে অন্যত্র বেড়াতে গেলে উপসর্গ কমে কিনা। ইতিহাস জেনে নেয়ার পরে এলার্জি পরীক্ষা করতে হবে স্কিন প্রিক টেস্ট বা রক্তের রাস্ট পরীক্ষা করা হয় সচরাচর। পরীক্ষায় সেই সমস্ত এলার্জেন ব্যবহৃত হয় যেগুলো রোগীর বাসস্থান এবং কর্মস্থলের আশপাশে পাওয়া যায়। পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে রোগের ইতিহাস মিলিয়ে ডাক্তার নির্ধারণ করবেন রোগীর সঠিক এলার্জি।
পুষ্পরেণু থেকে মুক্ত থাকার কিছু টিপস্ : দুপুর পর্যন্ত ঘরে থাকুন দুপুরের পরে বাতাসে পুষ্পরেণুর পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম হয়। ঝড়ো দিনে বা প্রবল বাতাস থাকলে বাইরে যাবেন না।
* চোখ বাঁচানোর জন্য সানগ্লাস ব্যবহার করুন।
* বাগানের ঘাস কাটার কাজে নিয়োজিত হওয়া চলবে না যদি কাটতেই হয়, তাহলে মাস্ক পরে কাজ করবেন।
* বাড়ির বাগানে এমন ধরনের গাছ বেছে বেছে লাগান যেগুলো এলার্জি তৈরি করে না।
* বাড়ির জানালা বন্ধ রাখুন। বিশেষ করে রাস্তায় চলার সময় গাড়ির কাঁচ তুলে দেবেন।
* পরাগায়নের মৌসুমে বনভোজনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকুন।
* ছুটির দিনগুলো দূষণমুক্ত এলাকায়, বিশেষ করে নদী বা সমুদ্রতীরে কাটাতে পারেন।
* বাড়ির বাগানের কোন গাছ বা আগাছার কারণে এলার্জি হচ্ছে, তা নিশ্চিতরূপ জানতে পারলে গাছটি অপসারণ করুন।
* কাজ শেষে বাড়িতে ফিরেই গোসল করুন। সুযোগ পেলেই চোখে পানি দিয়ে পরিষ্কার করুন।
* সঙ্গে সব সময় রুমাল বা টিস্যু পেপার রাখুন।
কার্যকর চিকিৎসা এখন আপনার নাগালের মধ্যেই : উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে যান। যদিও শুধু ওষুধের দ্বারা এলার্জি নিরাময় করা যায় না। তবে গত ২০ বছর আগের তুলনায় অনেক উন্নত ওষুধ আবিষ্কৃৃত হয়েছে যেগুলো আপনাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেবে। এই ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম। আপনার ডাক্তার আপনাকে জানাবেন। কিভাবে ওষুধের সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী করে দেয়। (যেমন নাকের স্প্রে যেগুলো নাকের ছিদ্র পরিষ্কার রাখে) ডাক্তার সেগুলো এড়ানোর পরামর্শ দেবেন আপনাকে।
এন্টিহিস্টামিন টেবলেট বা সিরাপ আপনার হাঁচি, চুলকানি বা চোখ জ্বলা কমাবে। তবে নাক বন্ধ হয়ে থাকা বা নাক দিয়ে সর্দি গড়ানোতে তেমন নাক বন্ধ হয়ে থাকা বা নাক দিয়ে সর্দি গড়ানোতে তেমন কার্যকর হবে না।
এন্টিহিস্টামিনের সুবিধা হচ্ছে, যখন প্রয়োজন তখন ব্যবহার করলেই হলো। এর জন্য কোর্স পূর্ণ করার প্রয়োজন নেই।
* এখন মিশ্র ওষুধও পাওয়া যায়। যেমন এন্টিহিস্টামিনের সঙ্গে স্যুডোফেড্রিন।
* নাকের মিশ্র স্প্রে যষ্টে কার্যকরী। এদের মধ্যে থাকে
* এন্টিহিস্টামিন যা দ্রুত হাচি এবং চুলকানো বন্ধ করে।
* ইপরাট্রোপিয়াম ক্রোমাইড নাক থেকে অবিরল পানি পড়ানো বন্ধ করে।
* স্টেরয়েড তীব্র প্রদাহে খুবই কার্যকর।
এই ওষুধগুলো নিয়মিত এবং যথানিয়মে ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়মিত চলতে হবে কিছু উপদেশ। যেমন-
* চোখে মেডিকেটেড ড্রপ ব্যবহারে আরাম পাওয়া যায়। এতে থাকে উপশমী লুব্রিকান্ট, এন্টিহিস্টামিন এবং স্টেরয়েড। নিয়মিত ব্যবহারে প্রদাহ অনেক কমে যায়।
* স্যুড্রোফেড্রিন টেবলেট নাকের রাস্তা পরিষ্কার করে দেয় এবং শুষ্ক রাখে। তবে এই ওষুধের কিছু পার্শ¦প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন শরীরে মৃদু কম্পন, মুখের অসুবিধা, দুশ্চিন্তা এবং রক্ত্চাপ বেড়ে যাওয়া সেই কারণে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তারা এই ওষুধটি খাবেন না।
* কার্টিসোল স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন না নেয়াই উত্তম। ইঞ্জেকশনের ফলে মাত্র এক বা দুই সপ্তাহের উপশম হয়। ফলে বার বার ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক মারাত্মক। সেই কারণে ক্যাটিনোল স্প্রে নেয়া ভালো।
* প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যে রসুন বেশ উপকারী। অনেকে গরম পানির বাষ্প নাকে টেনে নেয়। কেউ কেউ লবণ পানির মিশ্রণ নাকে টানে।
১. এ্যাজমা প্রতিরোধক অনেকক্ষেত্রে ভালো কাজ দেয়। এতে পুষ্পরেণুর পক্ষে সহজে এলার্জি সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না।
ইমিউনোথেরাপী ইঞ্জেকশন : ওষুধ দিয়ে উপসর্গগুলোর উপশম ঘটানো যায় মাত্র। নিরাময় হয় না। কোন কোন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অন্য পথের কথা বলেন। তারা অল্প ডোজে কিছুদিন পর পর এলার্জেন পুশ করেন রোগীর শরীরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে। এই ইঞ্জেকশন দিতে হয় অনেক দিন ধরে। কখনও মাসের পর মাস, কখনও বছরের পর বছর। তবে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এই ইঞ্জেকশন প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়।
ডা. গোবিন্দ দাস
দি এলার্জি এ্যান্ড এ্যাজমা সেন্টার
৫৭/১৫ পান্থপথ, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.