মাতৃভাষার স্বাদ by তাসনিনা ইয়াসমিন

ভোরের সোনালি রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে জানালায়। এই রোদ্দুরে ঘুম ভেঙ্গে গেল রোদেলার। অপূর্ব। অপূর্ব এই পৃথিবী। কী সুন্দর প্রভাতের রূপ সব কিছুই রোদেলাকে আকর্ষণ করে।
আজ ভোরবেলা প্রতিদিনের চেয়ে আরও বেশি ভাল লাগছে তার। কারণ আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেল মানুষের ঢল। সবাই ছুটছে শহীদ মিনারে। কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউবা সাদা-কালো পোশাক পরে আছে। রোদেলা থাকে ঢাকার পলাশীতে। রোদেলার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক আর মা ডাক্তার। বাবা সব সময় ব্যস্ত থাকেন। মা মানুষের সেবা নিয়ে ব্যস্ত। রোদেলার জন্য আজ অনেক আনন্দ বাবা-মা দু'জন কাছে আছেন। তাকে নিয়ে শহীদ মিনারে যাবেন। রোদেলা আগে থেকে ঠিক করেছে এবারে সে সাদা গোলাপ নিয়ে যাবে। এজন্য বাবাকে অনেক কষ্ট করে একমাত্র মেয়ের জন্য সাদা গোলাপ সংগ্রহ করতে হয়েছে।
বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে তিনজন। রোদেলা আজ মহাখুশি। বাবা-মাকে প্রশ্ন করতে থাকে, শহীদ মিনারে মানুষ কেন যায়? শহীদ মিনার কিভাবে হলো? আজ কি অনেক আনন্দের দিন? বাবা বলেন, না, মা আজ আনন্দের দিন নয়। আজ আমাদের জন্য শোকের দিন। পাকিস্তানীরা আমাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তারা বাংলার পরিবর্তে উদর্ুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। তারা আমাদের মুখের ভাষা ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। জোর করে উদর্ু বলাতে চেয়েছিল। কিন্তু না, বাংলা মায়ের ছেলেরা তা হতে দেয়নি। তারা এর দৃঢ় প্রতিবাদ জানায়। বাংলার দামাল ছেলেদের রুখতে পাকিস্তানীরা ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি বাঙালীরা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার সার বহন করে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সকালে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য মিছিল বের করে। মিছিলের মূল স্লোগান ছিল_ 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' মিছিলের প্রধান উদ্যোগী ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা। পরে এই মিছিলে আপামর জনতা যোগ দেয়। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে বের হয়ে বর্তমান শহীদ মিনারের দিকে যেতে থাকে। এমন সময় পুলিশ এসে বাধা দেয়। পুলিশ ছাত্রদের ওপর অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। বাংলা মায়ের ছেলেরা মায়ের ভাষার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে_ 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'বাংলা চাই, বাংলা চাই'। বর্বর পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ আরো নাম না জানা অনেকে। রক্তে ভেসে যায় বাংলার মাটি। এই স্মৃতি রার্থে নিমিত হলো শহীদ মিনার। আজ সে দিনটি তাই বাঙালী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় ভাষাশহীদদের শহীদ মিনারে গিয়ে।
রোদেলা বলে, তবে আমি কেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ি? আমারও তো অধিকার আছে বাংলা পড়ার। বাংলা ভাষায় প্রাণভরে কথা বলার। রোদেলা জানে, তাকে ইংরেজীতে কথা বলাতে অনেক চেষ্টা করেছে বাবা-মা। কিন্তু দাদির সহযোগিতায় সে মাতৃভাষাকে কাছে পায়। সে বাংলায় কথা বলতে শেখে।
"আটান্ন বছর আগে যাঁরা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন তাঁরা কি জানতেন এই বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত মানুষ শিশুকে জন্মের পর থেকে ইংরেজীতে কথা বলাবেন? তাঁরা কি জানতেন শিশু যখন কথা বলবে তখন থেকেই ইংরেজীতে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলবেন? তার পর থেকে শুরু শিা কার্যক্রম ইংরেজী মাধ্যমে। মাতৃভাষা শব্দটি সম্পর্কে জানতে পারবে না শিশু। শিশুকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, বড় হয়ে কী করবে? উত্তর দেয় আমেরিকা, লন্ডন যাব নয়তো জাপান, জামর্ান।" এক নিশ্বাসে বলে ফেলে রোদেলা। বাবা-মার মুখ কালো মেঘে ঢেকে যায়।
তারা কি কিছুটা অনুভব করতে পারবেন রোদেলার কষ্টটাকে? রোদেলার মতো হাজার হাজার ইংলিশ মিডিয়ামের শিশু আছে। তাদের কেউ হয়ত কারও কাছ থেকে রোদেলার বাবার মুখের গল্পের মতো কিছু শুনতে পাবে না। মাতৃভাষাকে কেউ জানতে পারবে না। তারা হয়ত জানবে না মাতৃভাষার স্বাদ।একুশের ভোরে শহীদ মিনারের দিকে যেতে যেতে মন খারাপ হয়ে যায় রোদেলার।

No comments

Powered by Blogger.