যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় সম্পর্কে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্স প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।
পাশাপাশি দেশটি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তার নীতিগত অবস্থানও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। জার্মানি মনে করছে, প্রতিটি দেশেরই যন্ত্রণাকর অতীত থাকে। সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথটি ওই দেশটিকেই খুঁজে বের করতে হয়। বাংলাদেশ সে পথটা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ফ্রান্স বলেছে, অতীতের অসমাপ্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি কীভাবে হবে, সেটি সুরাহার দায়িত্ব একান্তভাবেই বাংলাদেশের। এই দুটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা গতকাল ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে এই প্রতিক্রিয়া জানান।
যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া: লন্ডন থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের কনিষ্ঠ মন্ত্রী ব্যারনেস ভার্সি এক বিবৃতিতে বলেন, তাঁর সরকার এই রায় পর্যবেক্ষণ করছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার যে উদ্যোগ বাংলাদেশ নিয়েছে, যুক্তরাজ্য সরকার তা সমর্থন করে। তবে যুক্তরাজ্য সব ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী।
বিবৃতিতে বলা হয়, কিছু এনজিও এবং আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যধারা সম্পর্কে যেসব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাজ্য সরকার সেসব বিষয়েও সজাগ রয়েছে। ব্যারনেস ভার্সি বলেন, ‘আমরা আশা করব, এসব উদ্বেগ দ্রুত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিষ্পত্তির জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পদক্ষেপ নেবে, যাতে করে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সততা, স্বাধীনতা ও সুনাম বজায় থাকে।’
জার্মানির প্রতিক্রিয়া: গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে ফ্রাঙ্কো-জার্মান দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দুই রাষ্ট্রদূত। ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট কনিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন, সে সম্পর্কে আদালতের বাইরের কারও মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিচারকাজ সম্পন্ন হচ্ছে কি না, তা দেখতেই জার্মানি ও ইউরোপ আগ্রহী।
জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের বিষয়টিতে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তবে আপনাদের অতীতের অমীমাংসিত বিষয়ের সুরাহা কীভাবে হবে, সেটি ঠিক করার দায়িত্ব আপনাদের। একজন জার্মান নাগরিক হিসেবে শুধু এটুকুই বলতে পারি, যন্ত্রণাকর অতীত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তির জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়। আর আপনারা সেটাই করতে চলেছেন।’
আলব্রেখট কনিয়ে আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল বিশেষ করে যুক্তরাজ্য বিচারের প্রক্রিয়াগত বিষয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, ট্রাইব্যুনাল সেটিকে আমলে নিয়েছে। ট্রাইব্যুনালের কাজে প্রক্রিয়াগতভাবে বড় কোনো বিচ্যুতি ব্যক্তিগতভাবে আমার চোখে পড়েনি। আর আইনমন্ত্রী আমাদের (ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত) ট্রাইব্যুনালের আইন সম্পর্কে জানিয়েছেন, তিন দশকেরও বেশি সময় আগে ফৌজদারি দণ্ডবিধি বিষয়ে অভিজ্ঞ দুই জার্মান অধ্যাপক এ আইন প্রণয়নে যুক্ত ছিলেন। কাজেই এ আইন নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই।’
আইনমন্ত্রীর আশ্বাসে সন্তুষ্ট কি না—জানতে চাইলে ঢাকায় শীর্ষ এই জার্মান কূটনীতিক বলেন, ‘ইইউ রাষ্ট্রদূতদের আইনমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি একজন দক্ষ আইনজীবী, সম্মানিত ব্যারিস্টার এবং তাঁর ব্যাখ্যায় আমরা আশ্বস্ত। আমরা নিবিড়ভাবে ট্রাইব্যুনালের কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখব।’
ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া: একই বিষয়ে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মিশেল ট্রিনকুইয়ে বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট ফলপ্রসূ মতবিনিময় হয়েছে। আমরা তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তাই এ বিচার নিয়ে হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। অতীতের সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে, সেটি ঠিক করার দায়িত্ব প্রত্যেক দেশেরই নিজেদের বিষয়। কোনো কোনো দেশ ক্ষমা প্রদর্শনের নীতি অনুসরণ করেছে। আবার কোনো কোনো দেশ যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ট্রাইব্যুনাল চালু করেছে।’
বাংলাদেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে কি না—জানতে চাইলে মিশেল ট্রিনকুইয়ে বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। সম্প্রতি একটি জনমত জরিপে দেখেছি, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ায় তাদের সমর্থন জানিয়েছে।’
ঢাকায় ফ্রাঙ্কো-জার্মান দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন: গতকাল সকালে বারিধারায় ফ্রাঙ্কো-জার্মান দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বারিধারায় ইউরোপের দুই দেশের দূতাবাস নির্মাণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘এলিসি ট্রিটি’-এর সূবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকায় দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ইউরোপের দুই প্রধান অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংশীদারত্ব জোরদারের লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালের ২২ জানুয়ারি ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল এবং জার্মানির চ্যান্সেলর কনরাড আডেনর চুক্তিটি সই করেছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.