রান্নাঘরের অর্থনীতি by অসিত মুকুটমণি

রান্নাঘরের কিছু কথা আজ বলতে চাই। উন্নত দেশগুলোর রান্নাঘর আর টয়লেট পরিচ্ছন্নতম। মূলত অধিকাংশ অসুখ-বিসুখ এখান থেকেই সৃষ্টি হয় বা ছড়ায়। 'স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল', 'স্বাস্থ্যই সম্পদ', 'যে জাতি যত সুস্থ সে দেশ তত সম্পদশালী'। রান্নাঘরের কাজ হলো খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা।


এর মধ্যেও অসচেতনতা ও অবহেলায় ঘটে অপচয়। খাদ্যাখাদ্য তথ্য ও পুষ্টিমান না জানা বা অনুসরণ না করা যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে, তেমনি জাতীয় অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে। আর এ অপচয় ও নিয়ম ছিন্নতা স্বাবলম্বী ঘরেই বেশি হয়ে থাকে। গরিব বা সাধারণভাবে জীবনযাপিত ঘরে অপচয় কম হয় বা হওয়ার সুযোগও তেমন নেই। তবে পুষ্টিমান জানা ও সে মতে সামর্থ্য বিবেচনায় খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ না করার বিষয়টি ধনী-দরিদ্র সর্বত্রই প্রকট। ঢাকা মহানগরের কথাই বলি। পরিসংখ্যানের তথ্যচিত্র এ মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব না হলেও যারা পড়বেন তারা অবশ্যই একমত হবেন যে, আমাদের রান্নাঘরের কাজ স্বাস্থ্যসম্মত ও অপচয় রোধ সম্পৃক্ত হলে গৃহকর্তার খরচ যেমন কমত বাজারে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহের চাপও কমে প্রসারিত সরবরাহ পূর্ণ বাজার মিলে জনজীবনে স্বস্তি থাকত। মূল্যস্তর কমত, অপচয়জনিত ডাস্টবিনের সঞ্চয় এত স্টম্ফীত হতো না। রান্নাঘর প্রধানত শিক্ষাবিহীন বা অল্প শিক্ষিত বাইরের কর্মজীবীদের দখলে। সময় অতিক্রান্তের সঙ্গে বেতনাদি পাওয়া ও নিজেদের একটু স্বস্তির কথা ভাবা তাদের ক্ষেত্রে মোটেও অন্যায় নয়। সামগ্রিক অবস্থায় এসব গূঢ়তথ্য জানা তাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। সেখানে বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা যদি হাসিমুখে ওই কর্মীদের করণীয় ও বর্জনীয় ঠিক করে দেন, তদারকি করেন তাহলে অপচয় কমবে। প্রতিদিন বা একদিন পরপর প্রয়োজন অনুযায়ী বাজার করে তা যথাযথ সংরক্ষণ, রান্না ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পুষ্টিমান পাওয়াসহ সামগ্রিক খরচ ও বাজারে অহেতুক চাহিদার চাপ কমে যাবে। যদি সচ্ছল প্রতি পরিবারের ক্রীত খাদ্যাদির ১০ শতাংশও অপচয় হয় এবং সচেতনতা বাড়িয়ে তা যদি রোধ করা যায় তাহলে দ্রব্যের চাহিদা অনেক কমে বাজারে দ্রব্যমূল্য হ্রাস ও সরবরাহের পরিমাণের ওপর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলবে। খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ, রন্ধনের প্রক্রিয়া ও তা সংরক্ষণে ঢাকনার ব্যবহারসহ আধুনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেও পুষ্টিপ্রাপ্তি বৃদ্ধি করা যায়। প্রতি রাতে সংরক্ষিত খাদ্যদ্রব্য যাচাই ও প্রাধিকার ধার্যে রন্ধন ও সেবনে অপচয় রোধ সহায়ক। এ ছাড়াও প্রয়োজনের অতিরিক্ত তেল, মসলা ব্যবহার, ভাজাপোড়া খাবারের ক্ষতির দিক তুলে ধরে প্রাজ্ঞ চিকিৎসক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা যদি খাদ্যবস্তুর বিকশিত ও বিকল্প সমৃদ্ধ খাদ্য তালিকা সংযোজন করে সবাইকে সচেতন, আন্তরিক ও আগ্রহী করেন তাহলেও শুভ ফল পাওয়া যাবে। পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর, ঝুল-ময়লা, মাকড়সা, টিকটিকি, তেলাপোকা, ইঁদুর, মাছিমুক্ত রান্নাঘর সুস্থ জীবন ও বিকশিত অর্থনীতির সহায়ক। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রব্যের গুণ, পরিমাণ, মূল্যস্তর ও উৎপাদন, বিকশিত সামাজিক অবস্থানের জন্য গভীরভাবে বিবেচ্য। এ ক্ষেত্রে সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের এ বিষয়ে সচেতনতা ও কার্যকর করার ইচ্ছা বৃদ্ধি পেলেই বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশ সৃজন সহায়ক হবে। একই সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ তালিকায় সব ধরনের অপচয় রোধে শিক্ষা দেওয়া ও অনুসরণে আন্তরিক করে গড়ে তুলে আগামীর জাতীয় জীবন ও উন্নতি সুন্দর ও গতিশীল হবে আশা করা যায়। নানা দুর্যোগের করাল থাবায় প্রতি বছর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এ দেশে উৎপাদন করা শুধু ব্যয়বহুলই নয়, ভীষণভাবে কষ্টকরও। অন্যদিকে তার অপচয় আমাদের ১৫ কোটি ও দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মানুষের অর্থনীতি ও জাতীয় বিকাশের বিবেচনায়ও সর্বনাশের। সারাদেশের সচ্ছল পরিবারের এই অনিচ্ছাকৃত অপচয় রোধে সচেতনতা সৃষ্টি হলে দেশ ও জাতি নানাভাবে এগিয়ে যাবে। তখনই 'ছোট ছোট বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল'_ এমন প্রবাদ বাক্যের বাক্যার্থটি বাস্তবে মূর্ত হয়ে উঠবে।

অসিত মুকুটমণি :কবি
 

No comments

Powered by Blogger.