সফিউদ্দীন আহমেদ-শিল্পগুরুর চিরপ্রস্থান

বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার জগতে তার ভূমিকা পথিকৃতের। পঞ্চাশের দশকে এ দেশের সমাজ যাদের নেতৃত্বে নবযাত্রা শুরু করেছিল তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ। পঞ্চাশের দশকে আমাদের সমাজ, রাজনীতি, শিল্পকলা, সাহিত্যে একটি নবযাত্রা শুরু হয়েছিল,


যার পশ্চাৎপটে ছিল দেশভাগের তিক্ত স্মৃতি পেছনে ফেলে গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ এবং জাতীয় সাংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার অনন্য প্রচেষ্টা। তখনকার রিক্ত ঢাকাকে যারা প্রাণ দিয়েছেন, নতুন স্পর্শে জাগিয়েছেন তাদের ভূমিকাই সূচিত করেছিল নতুন যুগের। শিল্পকলার জগতে যারা তখন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানদের সহযাত্রী ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ। তাদেরই উদ্যোগে ভিত্তি পেয়েছিল চারুকলার শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। তারাই ছবি এঁকে পথনির্দেশ করেছিলেন আমাদের শিল্পকলার। সফিউদ্দীন আহমেদ এ দেশে ছাপচিত্রের উদ্গাতা। তার হাতে যাত্রা শুরু করে ছাপচিত্র নামক শিল্প আঙ্গিকটি। শিল্পবোদ্ধারা বিস্মিত হয়ে যান ছাপচিত্রে তার পারদর্শিতা আলো-ছায়ার কাজ, রেখার বিচিত্র ভঙ্গি ও গতি দেখে। তাই বলা যায়, ছাপচিত্রের তিনি শুধু পথিকৃৎই ছিলেন না এ আঙ্গিকে তিনি ছিলেন গুণী শিল্পীও। সমকালীন ভারতীয় শিল্পকলার জগতে সফিউদ্দীন শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত একটি নাম। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মানও। শুধু ছাপচিত্রেই নয়, তেলচিত্র, তাম্রতক্ষণ ইত্যাদি ফর্মেও তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তার ছবি হয়ে উঠেছে একান্ত দেশজ, একান্তভাবেই আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে স্বকীয়তায় ভাস্বর। বিপুল অর্জন সত্ত্বেও স্বভাবে নম্র, বিনীত ও আড়ম্বরহীন সফিউদ্দীন আহমেদকে কোনো শিল্পীসুলভ জাঁকজমক আকীর্ণ করতে পারেনি। বরং আজীবন নিজের অর্জন বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেই নবতর শিল্পসৃষ্টির বিরামহীন উদ্যমের মধ্যেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে তাকে। ব্যক্তিগত জীবনের এই নম্রতা তার ব্যক্তিত্বকে করে তুলেছিল অনুসরণীয়। ফলে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে আজ অবধি বহু নতুন শিল্পীর শিক্ষক হিসেবে, প্রেরণা ও প্রণোদনার উৎস হিসেবে তাকে বিশেষ ভূমিকায় দেখা গেছে। শিল্পকলার জগতে তিনি শেষ দিন পর্যন্ত অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তাই ৯০ বছর বয়সে প্রস্থানকেও অকাল প্রস্থান বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। তবে এ কথাও সত্য, বয়সোচিত জ্বরা, ব্যাধি ও ক্লান্তি তার শরীরেও বাসা বেঁধেছিল। দীর্ঘ রোগভোগের যন্ত্রণাও তাকে সইতে হয়েছে। তার চলে যাওয়া হয়তো অনিবার্য ছিল কিন্তু চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটি শিল্পযুগেরও অবসান ঘটতে চলেছে। বস্তুতপক্ষে তার প্রজন্মের খুব বেশি মানুষ আজ আর জীবিত নেই। বিশেষত পথিকৃতের ভূমিকায় থেকে যারা একদা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমাদের জাতিকে এবং বিপুল জীবনীশক্তি নিয়ে নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। এই বিরল মানুষদের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ক্রমশ ইতিহাসের সঙ্গে হারিয়ে চলেছি সংযোগ। এই মানুষদের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে একেকটি যুগের অবসান হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেই যুগাবসান যেন যুগের বিস্মৃতিও না হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের অগ্রযাত্রার প্রয়োজনেই সে যুগের শ্রেষ্ঠকীর্তি ও সেরা মানুষদের অবদানকে সঙ্গে করে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ, শিক্ষকতা, জীবনযাপন পদ্ধতি, তার নম্রতা, বিনয় ও নিজের কাজের প্রতি একাগ্র মনোনিবেশ নতুন প্রজন্মের সামনে অনুসরণীয় হিসেবে উপস্থাপিত হোক। সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ শিল্পানুরাগীদের জন্য উন্মুক্ত হোক, নবতর মূল্যায়নে উদ্ভাসিত হোক তার শিল্পসৃষ্টি_ এটিই আমাদের কামনা। শিল্পগুরু হিসেবে আখ্যায়িত এ গুণী শিল্পীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 

No comments

Powered by Blogger.