সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নারী-পুরুষের মিলিত সংগ্রাম by বদরুদ্দীন উমর

ভিকারুননিসা স্কুলে ছাত্রী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা যথার্থ। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ যেভাবে সারাদেশের স্কুল-কলেজে হয়েছে এটা এক অতি উচিত কাজ। কিন্তু এখানে এটাও বলা দরকার যে, ভিকারুননিসা ঢাকা শহরে বিত্তশালী বাঙালি পরিবারের ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখানে ছাত্রী নির্যাতনের


বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হয়েছে সেটা মফস্বলের অন্য সাধারণ স্কুলে এই ধরনের ঘটনায় ঘটতে দেখা যায় না। শুধু শ্রেণী নয়, জাতি প্রশ্নও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক



২০ জুলাই ২০১১ তারিখের 'দৈনিক সকালের খবরে' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীনের 'মরিয়ম মুরমুর লাশ কি আমাদের ছিল না?' শীর্ষক একটি লেখা দেখলাম। লেখাটি পড়ে আমার খুব ভালো লাগল, কিন্তু সেই সঙ্গে অবাকও হলাম। নাসরীন একজন বাঙালি নারী হিসেবেই এটি লিখেছেন, কিন্তু এই লেখার মধ্যে তিনি বাঙালির বাইরে অন্য জাতি, বিশেষত নিপীড়িত ও উপেক্ষিত ক্ষুদ্র জাতিভুক্ত এক নারীর ওপর নির্যাতন এবং তার বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা লিখেছেন এ ধরনের লেখা বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যায় না। তিনি নিজেও তার লেখাটির মধ্যে এদিকেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ বিষয়ে আলোচনার আগে নাসরীনের লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া দরকার। নারী নির্যাতনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার পর তিনি লিখছেন, 'ভিকারুননিসা স্কুল ও কলেজের শিক্ষক পরিমল কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছে এবং রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সিমলার দীঘিপাড়া গ্রামে সাঁওতাল নারী মরিয়ম মুরমুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উলি্লখিত সব ঘটনাতেই আমরা আক্রান্ত হয়েছি, বিক্ষুব্ধ হয়েছি। সমস্বরে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলেছি। কিন্তু সব আওয়াজের জোর এক ছিল না, সব প্রতিবাদের ঢংও এক হয়ে ওঠেনি। এর পেছনে কারণ অনেক। যখন ঢাকায় কোনো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তখন আমাদের নড়াচড়া বেশি হয়। নিজ শ্রেণী, নিজ এলাকা, নিজ স্কুল-কলেজ আক্রান্ত হলে আমরা প্রতিবাদী হয়ে উঠি। অর্থাৎ আঘাতটি নিজের পরিবারে, আত্মীয়দের মধ্যে কিংবা পরিচিতজনদের মধ্যে না হলে আমরা সেটি নিয়ে সচেতন হয়ে উঠি না, প্রতিবাদমুখর হই না।' দীর্ঘ হলেও প্রয়োজনবোধে আর একটি উদ্ধৃতি এখানে দিতে হচ্ছে বিষয়টির গুরুত্বের কারণে। এতে বলা হচ্ছে, 'বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ঘরানা এখনও অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী। মরিয়ম মুরমুর এই ছবি আমরা দেখে শুধুই চোখ বন্ধ করি, কিন্তু আমাদের মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হয় না। আমরা বাঙালি নারীর বিষয়ে যতটা তৎপর হয়ে পড়ি ঠিক ততটা আমলে নিতে চাই না আদিবাসী নারী নিপীড়নকে। আমরা ভাবি এটা আদিবাসীদের বিষয়, তারাই এর প্রতিবাদ করবে। আমরা একই ধরনের চিত্র দেখেছিলাম মান্দি নারী গিদিতা রেমাকে হত্যা করার ক্ষেত্রে। তখনও বুদ্ধিজীবী মহল চুপ ছিল। শহীদ মিনারে আদিবাসীরাই প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিল।'
নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে শ্রেণী, জাতি ইত্যাদি বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের চেতনা কী ভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে ও এর ফলে তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যে পার্থক্য ও তারতম্য দেখা যায় সে বিষয়ে এখানে যা বলা হয়েছে তা এক কঠিন সত্য। ভিকারুননিসা স্কুলে ছাত্রী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা যথার্থ। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ যেভাবে সারাদেশের স্কুল-কলেজে হয়েছে এটা এক অতি উচিত কাজ। কিন্তু এখানে এটাও বলা দরকার যে, ভিকারুননিসা ঢাকা শহরে বিত্তশালী বাঙালি পরিবারের ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখানে ছাত্রী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হয়েছে সেটা মফস্বলের অন্য সাধারণ স্কুলে এই ধরনের ঘটনায় ঘটতে দেখা যায় না। শুধু শ্রেণী নয়, জাতি প্রশ্নও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বাঙালির বিরুদ্ধে এই নির্যাতন হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যেভাবে ও যে পর্যায়ে দেখা যায় অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রে সেটা দেখা যায় না। নাসরীন সঠিকভাবেই বলেছেন যে, এ ব্যাপারে নারী সংগঠনগুলোর মধ্যেও জাতীয়তাবাদী ভেদাভেদ দেখা যায়। এটা আমরা খুব ভালোভাবে দেখেছিলাম ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমা অপহরণের বেলায়। তাকে অপহরণের বিরুদ্ধে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত পার্বত্য চট্টগ্রামের দু-একটি সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের পক্ষ থেকে আমরা ছাড়া আর কেউ তখন প্রতিবাদ করেনি, এই অপহরণের জন্য দায়ী সামরিক অফিসারের গ্রেফতার, বিচার ও শাস্তি দাবি করেনি। বাংলাদেশে বাঙালি নারী সংগঠনগুলোও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এগিয়ে আসেনি।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন এখন এক বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ফরাসি সমাজতান্ত্রিক দার্শনিক ফুরিয়র বলেছিলেন, কোনো সমাজে জনগণ সাধারণভাবে কত স্বাধীন ও শোষণমুক্ত তার ব্যারোমিটার হলো, সেই সমাজে নারী কতখানি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে যে নারী নির্যাতন হচ্ছে সে প্রসঙ্গে বলা চলে যে, একটি সমাজে সাধারণ মানুষ কতখানি শোধিত ও নির্যাতিত তার ব্যারোমিটার হলো, সেই সমাজে নারী নির্যাতনের মাত্রা ও ব্যাপকতা।
নারী নির্যাতন অপরাধেরই একটি রূপ। চারদিকে অপরাধ আজ যত ব্যাপক ও বিপজ্জনকভাবে দেখা যাচ্ছে আগে কোনো সময়েই তা দেখা যেত না। প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে, বাংলাদেশে অপরাধের জগৎ আজ কতখানি ও কী ভাবে বিস্তৃত হয়েছে। খোদ রাষ্ট্র ও সরকার যেভাবে নিজেরাই নানা ধরনের অপরাধের বিস্তার ঘটাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ এখন অপরাধীদের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে সরকার, আদালত, আইন রক্ষাকারী সংস্থা সবকিছুই আছে, কিন্তু কোনো কিছুই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন তো করেই না, বরং উল্টো কাজ করে পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। কাজেই বাংলাদেশে নারী নির্যাতন বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সাধারণভাবে অপরাধের বিস্তারের সঙ্গে সম্পর্কিতভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, হাত ধরাধরি করে চলছে।
বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশে অন্য জাতিভুক্ত লাখ লাখ মানুষের বাস। বাংলাদেশে আজ শোষণ-নির্যাতনের শিকার সংখ্যাগতভাবে সব থেকে বেশি বাঙালিরা। কিন্তু যারা জাতিগত সংখ্যালঘু তাদের ওপর এই নির্যাতনের মাত্রা সব থেকে বেশি।
প্রথমত তারা শ্রেণীগতভাবে গরিব। দ্বিতীয়ত তাদের কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। এমনকি লোকগণনার সময় জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের গণনা করা হয় না। সংবিধানে যেহেতু বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সকল নাগরিক জাতি হিসেবে বাঙালি, কাজেই বাংলাদেশে সকলেই বাঙালি! এভাবে অন্যদের জাতিগত পরিচয়কে উড়িয়ে দিয়ে তাদের বাঙালি বললেও বাঙালিদের মতো অধিকার তাদের নেই। তাদের প্রতি এক ধরনের জাতিগত বিদ্বেষ শুধু যে সরকারি নীতি ও কার্যকলাপের মধ্যেই দেখা যায় তাই নয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এটা দেখা যায়। এই বুদ্ধিজীবীদের দেখা যায় ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু জাতিগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিনিধি ও প্রবক্তা হিসেবে। এই বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এনজিওদের অর্থ সাহায্যে যখন আদিবাসীদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পত্রপত্রিকায় প্রচার লাভ করেন, তখনও তারা কৌশলের সঙ্গে বাঙালি শাসকশ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের নীতিই কার্যকর করেন। কাজেই এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বড়দাশ মুনি, নওগাঁর আলফ্রেড সরেন, মধুপুরের চলেশ রিছিল ও পিরেন স্নালের মতো পুরুষই হোন অথবা কল্পনা চাকমা বা মান্দি গিদিতা রেমার মতো নারীই হোন, তাদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠ ও কলম জোরদার হয় না। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, এই জাতিগত সংখ্যালঘুরাই বাংলাদেশের শোষিত-নিপীড়িত জনগণের মধ্যে সব থেকে বেশি শোষিত, নিপীড়িত এবং অধিকারহীন।
এই নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যেমন জাতিগত দিক আছে, তেমনি আছে শ্রেণীগত দিক। এই উভয় দিক হিসেবে রেখেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এই আন্দোলন স্বাভাবিকভাবে জাত্যভিমানী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী বাঙালিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে হবে। অন্যদিকে এই আন্দোলনকে শোষিত-নিপীড়িত জাত্যভিমানহীন সাধারণ গরিব বাঙালি জনগণের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এই আন্দোলন কোনো সামাজিক বা নৈতিক আন্দোলন নয়। এ হলো এমন এক রাজনৈতিক আন্দোলন যা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের খেলা নয়। এ হলো সমাজের ভিত্তি ও কাঠামো পরিবর্তনের আন্দোলন। এমন এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যেখানে সাধারণভাবে মানুষের শোষণ-নির্যাতন মুক্তি ঘটবে ও সেই সঙ্গে দূর হবে নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন পুরুষের দ্বারাই হয় বিপুল অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কিন্তু নারী নির্যাতন নারীরাও করে থাকে। এর মানে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত থাকে শ্রেণী ও জাতি প্রশ্ন। সাধারণভাবে সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রেণী ও জাতির ভিত্তিতে শোষণ-নির্যাতন করা হয়। এ কারণে নারী নির্যাতনকে শুধু নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতন হিসেবে দেখে একে এক লিঙ্গ সমস্যা হিসেবে উপস্থিত করার অপচেষ্টা নানা সাম্রাজ্যবাদী চক্র ও মহল থেকে করা হয়। এ বিষয়ে সাবধানতার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। কারণ, সাধারণভাবে সমাজে জনগণের শোষণ ও নির্যাতন মুক্তি না হলে বিচ্ছিন্নভাবে নারী নির্যাতন বন্ধ, এমনকি কমিয়ে আনা সম্ভব, এ চিন্তা ভ্রান্ত এবং এক ধরনের মূঢ়তা। সেই সঙ্গে এ চিন্তা বিপজ্জনক, কারণ এর দ্বারা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বিভ্রান্ত, বিভক্ত ও বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা।
২৫.৭.২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.