গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন ও ভবিষ্যত কর্মপন্থা by ড. মিহির কুমার রায়

সম্প্রতি ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের ২০৫০ সালের বাংলাদেশ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী জাতীয় কর্মশালা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। দ’ুদিনের এ কর্মশালায় মোট আটটি সেমিনারের আয়োজন করা হয় দেশ বরেণ্য অর্থনীতিবিদদের উপস্থাপনায় এবং তার মধ্যে একটি সেমিনারের বিষয় ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর ও ভবিষ্যত উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ।
সেমিনারে বি.আই.ডি.এস কর্তৃক পরিচালিত ১৯৮৭-৮৮ সালের প্যানেল সার্ভের উপাত্তকে বেজ ধরে ২০০৮ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের যে সমস্ত পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়েছে তার একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়। এসব তত্ত্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গৃহস্থালীর আকার ৪.৯৩; মোট জনসংখ্যায় শিশুর হার শতকরা ৩৩ ভাগ, কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার শতকরা ৫৮ ভাগ, বৎসরান্তে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্য ভাগ, শিশু বিশেষত কন্যা শিশুদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল গমনের হার যথাক্রমে ৯৪ ও ৭৩ ভাগ, মানবীয় মূলধনের ইতিবাচক পরিবর্তন কৃষি থেকে অকৃষি পেশায় গতিশীলতা বৃদ্ধি, ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা মোট কৃষক পরিবারের ৪০ ভাগ, গড় কৃষি জমির আকার ০.৫৬ হেক্টের, ভাড়াটে জমির বাজার প্রসার সেখানে ভাড়াটে জমির কৃষকের হার মোট কৃষকের শতকরা ৫৪ ভাগ, শ্রম বাজারের ব্যবস্থাপনা চুক্তি ভিত্তিক, সেচের আওতাভুক্ত জমি মোট চাষকৃত জমির শতকরা ৭৮ ভাগ, জিডিপিতে কৃষির অবদান শতকরা ২০ ভাগ ,শস্য থেকে আয়ের উৎসে শতকরা হারে ধানের অবদান শতকরা ৬৩ ভাগ ইত্যাদি। উপরোলিখিত উপাত্ত থেকে একটি দিকনিদের্শনা পাওয়া যায় যা ইতিবাচক পরিবর্তন পরিসংখ্যানের চিরায়ত নিয়মে। এখন প্রশ্ন আসে গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর বা পরিবর্তন কেবলইকি সংখ্যাতত্ত্বের মানদ-ে বিচার্য নাকি তার একটি গুণগত অংশ রয়েছে।
বিশ্বায়নের যুগে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে সার্বিক সামাজিক ও মানবীয় মূলধনের যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরকে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করেছে। সমাজভিত্তিক গ্রামীণ জীবন যেখানে সামাজিক আচার-আচরণগুলো জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করত সেগুলো এখন আর দেখা যায় না। তার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় সামাজিক সংগঠনগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা। যেমন ষাটের দশকে কুমিল্লা অঞ্চলে সমবায় আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিশেষত ক্ষুদ্র কৃষকদের নিয়ে এবং পরবর্তিতে স্বাধীনতাত্তোর পর্যায় ক্রমে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দেয়া যায় কৃষক সমবায় সমিতি (কে.এস.এস.) এর নামে। তখনকার সময়ে কুমিল্লা জেলাকে বলা হতো সমবায় আন্দোলনের সুতিকাগার এবং সারা দেশের সমবায় আন্দোলনের পথ নির্দেশক। বর্তমান সে উদ্যোগগুলো মৃতপ্রায় এবং সমবায়ের মূলমন্ত্রগুলো যেমন দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ, যাহা পাই যেন জয় করে পাই, গ্রহণ না করি দান, ইত্যাদি আর নেই। বাজার অর্থনীতির চাপে পড়ে বেশির ভাগই এক সাথে সমবায়ভিক্তিক সামাজিক জীবনযাপনের চেয়ে এককভাবে বসবাসে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বিধায় কমিউনিটি জীবনের উপাদানগুলো ধীরে ধীরে দূরে চলে এসেছে। একটি শ্রেণী গ্রামাঞ্চলে বাজার অর্থনীতির বাণী প্রচার করে একটি শক্ত ভিত্তি রচনা করে চলেছে অদ্যাবধি। ফলে সমাজভিত্তিক জীবন থেকে এককভিত্তিক জীবনের উত্তরণ আমাদের গ্রামীণ সমাজে নানাবিধ নেতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
সমসাময়িক কালে সমাজ কাঠামো ও নেতৃত্বে যে পরিবর্তন এসেছে তা এর আগে দেখা যায়নি। সমাজের নেতৃত্ব কৃষি থেকে অকৃষিতে স্থানান্তর তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। যার জমি যত বেশি, সমাজ কাঠামোতে তার প্রভাব বেশি এ ধারণাটি এখন আর নেই। কেবল জমি হলেই চলবে না সেটা উৎপাদনশীল হতে হবে তবেই তো আয় বাড়বে। নচেত এ জমির মালিকানা কেবল আত্মতুষ্টির বস্তু হয়েই থাকবে। সম্প্রতি কুমিল্লা জেলার লাখসাম উপজেলার আমুয়া গ্রামে একটি গবেষণায় দেখা যায় এখানে আদি মুসলিম যেমন আছে তেমনি আছে সন্দ্বীপ থেকে আসা নদী ভাঙ্গা লোক ও রেওয়াজি অর্থাৎ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা লোক। যারা সন্দ্বীপি তারা গরিব ভূমিহীন কৃষি/শ্রমিক, আর যারা রেওয়াজি তারা চুপচাপ আর আদি মুসলিমরা নিজেদের স্থায়ী হিসাবে ধরে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত থাকে। পরিবর্তন যেটুকু সংগঠিত হয়েছে তা হলো টাকার খেলা এবং আর্থিক সম্পদ যার হাতে আছে সেই ক্ষমতা কাঠামোর পুরোটা দখল করে আছে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের ইউপি সদস্যকে যখন প্রশ্ন করা হয় আপনার দৃষ্টিতে একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে গ্রামীণ অর্থনীতির কি কি পরিবর্তন লক্ষণীয়, জবাব আসে মূল বিষয়ে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি যদিও রাস্তা, বিদ্যুত, গ্যাস ইত্যাদি জীবনের আরাম ও বিলাসিতাকে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করেছে। আমরা যা হারিয়েছি তা হলো হাজার বছরের লালিত সমাজভিত্তিক জীবন, সহমর্মিতা, নৈতিকতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক জীবন।
আকাশ সংস্কৃতি আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিকে যেভাবে গ্রাস করেছে তা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। সারা বাংলাদেশে অঞ্চলভিত্তিক যে সংস্কৃতিক বলয় চিরায়তভাবে লালিত হয়েছিল আজ সেগুলো মৃত পায়। তার বিপরীতে অপসংস্কৃতি যা রুচি বিবর্জিত তা আমাদের যাত্রা, পালাগান, কবিতা গান, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, গম্ভীরা, কাঠুগান, পুঁথিপাঠ, জারি, পটগান প্রভৃতিকে একেবারেই বিতাড়িত করে দিয়েছে। ফলে এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত জনগণ তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আর সে পেশায় সংযোগ করতে পরিবেশ পাচ্ছে না অর্থনৈতিক/সামাজিক অবস্থানের কারণে। গ্রামীণ খেলার মাঠগুলো খেলোয়াড়দের পদচারণায় মুখরিত ছিল আর এখন তারা ক্লাবঘরে বা চা স্টলে বসে টেলিভিশন/ভিসিআর দেখে সময় কাটাচ্ছে অকাতরে। এই যে সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন এর শেষ কোথায় এবং আমাদের শিকড়ের পরিচয়কে কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানে না বা জানতে চায় না। গ্রামীণ জীবনের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠে যখন দেখা যায় বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শ্রমিকদের কষ্টার্জিত পাঠানো অর্থ নিয়ে পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্ব। প্রায়ই শোনা যায় এই অর্থ গ্রামাঞ্চলে কোন উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত না হয়ে জমি ক্রয়, বাড়ি নির্মাণ, ভোগ-বিলাস ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত হয় ফলে বিগত দিনগুলোতে জমির দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা অন্য কোন খাতে হয়ে উঠেনি এবং এর ফলে জমি বিক্রির ব্যবসা করে অনায়াশেই একজনকে কোটিপতি হতে দেখা যায়। অথচ এই অর্থ যদি নিয়ন্ত্রিত উপায়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত হতো তাহলে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান বাড়ত, কৃষি ও অকৃষি কাজে উৎপাদন বাড়ত, দেশের দারিদ্র্য মোচনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত অথচ ঘটেছে তার উল্টোটি।
পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা বদলেছে এবং রূপান্তর ঘটছে। জমি দখল, বিল দখল, খাল দখল, নদী দখল এখন এক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। একটিও জলাধারা সেটি নদী বা বিল বা খাল যাই হউক না কেন যদি শুকিয়ে যায় তা হলে এগুলোকে কেন্দ্র করে যাদের জীবন জীবিকা তা ধ্বংস হতে বাধ্য এবং বাস্তবে তাই ঘটছে। ভৌগোলিক কারণে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে তাতে সুশীল সমাজ, পরিবেশবিদসহ সমাজসেবীরা খুবই সোচ্চার কিন্তু অসাধু মানুষের কারণে বনভূমি উজাড়, নদী দখল, জলাধার ভরাট চলছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরের সিংহভাগ দখল করে আছে কৃষির রূপান্তর এবং এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশন সদস্য ড. ম-ল (২০১২) উল্লেখ করেন বিভিন্ন প্রস্তাবনা যথা : ১. উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ; ২. খরচ কমানোর জন্য ক্রমাগত উচ্চফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবনের সরকারের নীতির সমর্থন ও উৎসাহ প্রদান অব্যাহত রাখা; ৩. সেচ ও সারের খরচ কমানোর লক্ষ্যে যেসব গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে সেগুলো দ্রুত সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা; ৪. কৃষির সঙ্গে শিল্পখাতের বিনিময় হার বরাবরই বিপক্ষে যা ঘুরিয়ে দিয়ে কৃষির অনুকূলে আনা; ৫. কৃষির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় শ্রম শক্তির বিভাজন ও টেকসই প্রযুক্তির প্রসার বিশেষত যান্ত্রিক সেচ প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার কৃষি বৈচিত্র্যায়নের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে উল্লেখযোগ্যভাবে এবং যান্ত্রিক চাষাবাদের প্রচলনও ঘটিয়েছে বিস্ময়করভাবে।
গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর কেবল সংখ্যার মানদ- বিচার না করে গুণগত মানদ-ে দেখা হলে দেখতে পাওয়া যায় সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অসাধুতা গ্রামীণ অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। বাড়ছে শ্রেণী ও আয় বৈষম্য। বাড়ছে অস্থিরতা। আবার ইতিবাচক উন্নয়নও হচ্ছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শহরের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.