২০০৯ থেকে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা একটি পর্যালোচনা by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দেশী-বিদেশী সকল পর্যবেক্ষক মহল একবাক্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছে।
অতীতের সকল নির্বাচনের চাইতে এই নির্বাচনে জালভোট প্রদানসহ সকল ধরনের অনিয়ম ও হস্তক্ষেপ রোধ করা সম্ভব হয়েছে, ‘যাকে খুশি তাকেই ভোট’ প্রদানের নীতি বাস্তবে প্রয়োগ করা গেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন একটি বড় ধরনের অর্জন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংযোজন। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে এবং আসনে জয়লাভের ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। মহাজোট সরকারের যাত্রার শুরু থেকে এ পর্যন্ত যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনটিতেই অতীতের মতো সরকারী হস্তক্ষেপের অভিযোগ বিরোধী মহল, দেশী ও বিদেশী পর্যবেক্ষক মহল, মিডিয়াসহ কোন সংশ্লিষ্ট মহল করেনি। স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি বড় ধরনের সাফল্য। বাংলাদেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় ধরনের সক্ষমতাও অর্জন করেছে বলা যায়। এর কৃতিত্ব একদিকে নির্বাচন কমিশন, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকারকেও দিতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের এই বিশ্বাসযোগ্য অর্জন ও অবস্থানকে অটুট রেখে সম্মুখে চলা, বজায় রাখা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কোন বিকল্প নেই। উল্লিখিত বক্তব্যসমূহ তথ্য-প্রমাণসহ নিচে তুলে ধরা হচ্ছে।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই দেশব্যাপী উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী মহাজোট ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই উপজেলা নির্বাচনে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে দেশের ৪৮১টি উপজেলার এতবড় একটি নির্বাচন তখন নির্বিঘেœ সম্পন্ন করেছে। এটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সবচাইতে বড় জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন; যেখানে উপজেলাভিত্তিক চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ হাজারের অধিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের একটি দুরূহ ও কঠিন দায়িত্ব ছিল। নির্বাচন কমিশনের মধ্যে তখন ওই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বেশ দ্বিধা ও সংশয় ছিল। কিন্তু যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকার কোনভাবেই নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেনি তাই নির্বাচন কমিশন নির্বিঘেœ তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। ফলে তখন উপজেলা নির্বাচনও দেশে-বিদেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অর্জন।
অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ২০০৯ সালের পর থেকে সকলের মধ্যেই নানা সংশয় ও সন্দেহ ছিল ভবিষ্যত উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনসমূহে ক্ষমতাসীন সরকারের হস্তক্ষেপ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোট কারচুপির। এ ক্ষেত্রে ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্নতর হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক মহল, সুধীসমাজ, মিডিয়া ইতিবাচক এসব অর্জনকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না, অর্জনের এই ক্ষেত্রটিকে ধরে রাখা এবং এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে কিছু বলছে না।

স্মরণ করা যেতে পারে জাতীয় নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় পার্টি প্রধানের ছেড়ে দেয়া আসনসমূহে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বগুড়া-৬ আসন থেকে সাবেক স্পীকার জমিরউদ্দিন সরকার এবং বগুড়া-৭ আসন থেকে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জয়লাভ করেন। তাঁরা উভয়েই সেখানকার স্থানীয় কেউ ছিলেন না। স্থানীয় পর্যায়ে তাদের মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ ও মতবিরোধও যথেষ্ট ছিল। কিন্তু অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা দু’জনেই সেখানে বিজয়ী হয়েছিলেন। বগুড়া অঞ্চলে বিএনপির ভোটের প্রাধান্যের প্রতিফলন তাতে ঘটেছিল; অন্যদিকে বাগেরহাট-১ এবং রংপুর-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থিগণ জয়লাভ করেছিলেন, রংপুর-৭ আসন থেকে বেগম রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। তবে কুড়িগ্রাম-২ এবং সুনামগঞ্জ-৪ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থিগণ তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থিগণ সেখানে জয়লাভ করেন। এরপর ভোলা-৩ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন আদালতের রায়ে সদস্য পদ হারালে উপনির্বাচনে বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন অংশ নেন। টানটান উত্তেজনা ছিল ওই নির্বাচনে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সাহসিকতার সঙ্গে ভোলার উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। নির্বাচনে প্রশাসনিক বা দলীয় কোন হস্তক্ষেপ ঘটেনি। হবিগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার কারণে বিএনপি জয়লাভ করে। মোট ১০টি উপনির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে ৩টিতে জয়লাভ করেছিল। এর পর ২০১২ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আন্দোলন করার কারণে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে তারা বিরত রয়েছে। এরপর দেশে আরও ৫টি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব উপনির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় সেগুলোতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ত হয়নি, তবে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ বা কারচুপির কোন অভিযোগ ওঠেনি। বেশ ক’টি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। গত ৪ বছরে দেশে মোট ১৫টি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলোর একটিরও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোন অভিযোগও ওঠেনি অতীতের জাল ভোট প্রদান, সীলমারাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনিÑ এটিকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
গত ৪ বছরে দেশে ৪টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমে ছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এটিকে নিয়ে টানটান উত্তেজনা ছিল, ভোট গণনায় হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এতটাই শক্ত অবস্থানে ছিল যে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকগণ সবকিছু গুটিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ব্যাপক উত্তেজনা ছিল নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মিডিয়ার প্রচার এমনই একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল যে, নারায়ণগঞ্জ যেন এই সময়ের মাগুরা হতে যাচ্ছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শামীম ওসমানকে সমর্থন জানায়, বিদ্রোহী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ভোটারদের নীরব সমর্থন লাভ করেন। বিএনপি মধ্যরাতে তাদের প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে আসতে বাধ্য করলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমানই ছিলেন। সামগ্রিকভাবে ভোট সুষ্ঠু, অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হয়েছিল, তাতে আইভী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। নবগঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়েও নানা উত্তেজনা ছিল। বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশ বড় ধরনের ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। সর্বশেষ রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। সব ক’টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের আশঙ্কা কোন কোন মহল থেকে করা হয়েছিল, বাস্তবে সেখানে সরকারী মহল থেকে হস্তক্ষেপ করার কোন ঘটনাই ঘটেনি। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে জয়-পরাজয় নিয়ে বড় ধরনের উত্তেজনা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে নির্বাচনের ব্যাপারে সকল মহলেরই দৃষ্টি খুব তীক্ষè থাকে, সেটি এসব নির্বাচনে লক্ষ্য করা গেছে। তবে নির্বাচনের সামগ্রিক আয়োজন থেকে ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়ায় এখন যে ধরনের স্বচ্ছতার নজির সৃষ্টি হয়েছে তার গুরুত্ব ব্যাপক। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের জন্য এটি বড় ধরনের অর্জন।
সবচাইতে কঠিন, জটিল ও দুরূহ কাজটি ছিল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। এই সময়ে মোট ৪,২৮১টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অতীতে এ নির্বাচনে সরকারী দল, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছিল অবধারিত। এবার প্রার্থী এবং সমর্থকদের বাড়াবাড়ির ফলে মাত্র ২৬টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। বাকি নির্বাচনসমূহ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ ২,১৬০টি, বিএনপি ১,৫৭৯টি, জামায়াত ১৫৪টি, জাপা (এরশাদ) ১২১টি এবং স্বতন্ত্রসহ অন্যান্য দল মোট ২৪১টি আসনে জয়লাভ করেছে। এই নির্বাচনে সরকার ও প্রশাসন যদি হস্তক্ষেপ করত কিংবা দলের সমর্থকদের যা খুশি তা করার সুযোগ প্রদান করত, তাহলে অতীতের মতো নানা ধরনের অনিয়ম ও মারামারি অনিবার্যভাবেই ঘটত। সরকার, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সে ধরনের কোন কিছু প্রশ্রয় না দেয়ায় অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইউনিয়ন পরিষদের এত সব নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ২৭৩টি পৌরসভার নির্বাচনও একইভাবে সম্পন্ন করা গেছে। এতে ১৩০টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থিগণ জয়লাভ করেছিলেন। বিএনপি ১১৮টি, জামায়াত ৬টি, জাপা (এরশাদ) ২টি এবং স্বতন্ত্রসহ অন্যান্য দল ৬টি পৌরসভায় জয়লাভ করেছিল। এসব নির্বাচনেও সরকার, প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের অবস্থান আইনানুগ ছিল। ফলে নির্বাচনসমূহের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোন সমস্যা তৈরি হয়নি। বাংলাদেশে গত চার বছরে এতসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিয়ে উত্তেজনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় কোন নির্বাচন নিয়ে জনমনে কোন অসন্তোষ তৈরি হয়নি। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে পেরেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এটি বড় ধরনের ইতিবাচক ঘটনা। বাংলাদেশ অবাধ নির্বাচনের সক্ষমতা অর্জনে বড় ধরনের অগ্রগতি লাভ করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর ব্যত্যয় ঘটবে নাÑ এটি শুধু প্রত্যাশার কথা নয়; বাস্তবে দেখার কথা আস্থার সঙ্গে ভাবা যেতে পারে। বাংলাদেশ এখন সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে কোন সন্দেহ থাকলে রাজনৈতিক দলসমূহ, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমসমূহ স্পষ্ট করে বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারে, নির্বাচন কমিশন এবং সরকার যথাযথ আইনী ও বিধিবিধানগত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.