বিটিআরসির সাঁড়াশি অভিযান ॥ তোলপাড়! by ফিরোজ মান্না

বিটিআরসির সাঁড়াশি অভিযানে বৈধপথে দেশে দেড় কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল বেড়ে গেছে। বিটিসিএলসহ চারটি আইজিডব্লিউর মাধ্যমে বর্তমানে প্রতিদিন সাড়ে চার কোটি মিনিট কল দেশে আসছে।
এক সপ্তাহ আগেও দেড় কোটি মিনিট কল অবৈধপথে দেশে আসত। বাড়তি কলের রাজস্ব এখন সরকারের ঘরে জমা হচ্ছে। শনিবার অবৈধ ভিওআইপি করার কারণে আরও তিনটি আইএসপি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই নিয়ে মোট ২১ টি আইএসপি ও তিনটি পিএসটিএন টেলিফোন কোম্পানি বন্ধ করে দেয়া হলো। অন্যদিকে, র্যাংকসটেলের চেয়ারম্যান রউফ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ র‌্যাংকসটেলের ১২ জনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা দায়ের করেছে বিটিআরসি। তিনটি ফোন কোম্পানি বন্ধ করে দেয়ার কারণে কয়েক লাখ গ্রাহক চরম বিপাকে পড়েছে বলে দাবি করেন পিএসটিএন কোম্পানির কর্মকর্তারা।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) জিয়া আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, টেলিকম সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত করা হবে। এই সেক্টরটি একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে টেলিযোগাযোগের বিকল্প নেই। আগামী প্রজন্মকে শিৰিত করে গড়ে তুলতে এই সেক্টরের গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে টেলিযোগাযোগ সেক্টরের ৰতি হোক সেটা কিছুতেই মেনে নেয়া হবে না। এই দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের উৎখাত করতে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। এক সপ্তাহ ধরে অভিযান চালানোর কারণে বৈধপথে প্রতিদিন দেড় কোটি মিনিট কল বেড়েছে। বর্তমান সরকার ৰমতায় আসার আগে প্রতিদিন দুই কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল দেশে আসত। সরকার ৰমতায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যে এটা বেড়ে তিন কোটি মিনিটে দাঁড়ায়। আর এখন কল বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার কোটি মিনিটে। অভিযান অব্যাহত থাকলে আন্তর্জাতিক কল আরও বহু গুণে বেড়ে যাবে।
বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়া হবে না। সরকারের রাজস্ব বাড়াতে অভিযান চলবেই। অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েজ ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসায়ীরা যত শক্তিশালীই হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিটিআরসি পিছপা হবে না। শনিবার সিরিয়াস ব্রডব্যান্ড, আইএসএন ও গ্রামীণ সাইবারনেট লিমিটেড নামের তিনটি আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডর) বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই নিয়ে ২১টি আইএসপি বন্ধ করা হলো। ওয়ালটেল, ঢাকা ফোন ও র‌্যাংকসটেল নামের তিনটি পিএসটিএন টেলিফোন কোম্পানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২১টি আইএসপির মোট ৬শ' এমবিপিএস (পার সেক্টেন্ড মেগাবাইট) ব্যান্ডউইথ এখন বিটিআরসির হাতে রয়েছে।
এদিকে, ঢাকা ফোনের ৭৫ হাজার, র‌্যাংকসটেলের দেড় লাখ এবং ওয়ালটেলের ১৫ হাজারের মতো গ্রাহক এখন চরম বিপাকে পড়েছে। তারা এসব কোম্পানি থেকে টেলিফোন সংযোগ নিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনটি কোম্পানি অবৈধ ভিওআইপি করার দায়ে বিটিআরসি তাদের অফিসসহ সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এই ফোনগুলো প্রিপেইড ল্যান্ড ফোন। সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকার উপরে রিচার্জ করা যায়। এমন অনেক গ্রাহক আছে তারা টেলিফোনে অনেক টাকা রিচার্জ করে রেখেছে। এই হিসাবে কয়েক কোটি টাকা ফোন কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়ে রেখেছে। তাছাড়া সংযোগ নেয়ার সময় আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়েছে। টেলিফোন কোম্পানিগুলো চালু না হলে গ্রাহকদের কয়েক শ' কোটি টাকা ফোন কোম্পানীর হাতে থেকে যাবে। ক্ষতিগ্রস্থ হবে গ্রাহকরা। রাজধানীর ইস্কাটন রোডে ফুটপাথে টেলিফোন ব্যবসায়ী হাসান জানান, এক সপ্তাহ আগে তিনি ৭ শ' টাকা রিচার্জ করেছে। এখন তার ফোনে কয়েক শ' টাকা রয়ে গেছে। এই টাকা কিভাবে ফেরত পাবেন সেই চিন্তা করছেন। র‌্যাংকসটেলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে দফায় দফায় তিনি যোগাযোগ করছেন। কিন্তু তিনি তাঁর মোবাইল ধরছেন না। হাসানের মতো অনেক গ্রাহক একই চিন্তায় পড়েছেন। বিটিআরসির অভিযান টেলিযোগাযোগ খাতে দেশীয় বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে বলে পিএসটিএন কোম্পানিগুলো মনে করছে। তারা বলেছে, কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এই সব কোম্পানিতে কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। যদি কোন কোম্পানি অবৈধ ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত থাকেই তাহলে ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে টেলিযোগাযোগ আইনে জরিমানা করা যেতে পারে। কিন্তু সুইচ রুম বন্ধ করে জনসেবায় নিয়োজিত কোন প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা কোনভাবেই উচিত না। এটা বেআইনী এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। তিন ফোন কোম্পানি বন্ধ করে ৫শ' কোটি টাকার বিনিয়োগ চরমভাবে হুমকির মধ্যে পড়েছে। আর কোম্পানিগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
তবে বিটিআরসির পৰ থেকে বলা হয়েছে, বেশ কিছু দিন আগে থেকে জনগণের কাছ থেকে অবৈধ ভিওআইপি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার জন্য বিটিআরসির ওয়েবসাইটে তথ্য দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এ সংক্রান্ত বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে একাধিকবার । বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যেসব পিএসটিএন কোম্পানি অবৈধ ভিওআইপি করে না সেই সব কোম্পানীর কাছ থেকে সংযোগ নিতে। বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, অনেকদিন ধরে পিএসটিএন কোম্পানিগুলো বিটিআরসির কাছে কিছু সুবিধা চেয়ে আসছিল। তারা বলছিল কিছু কিছু ভিওআইপি না করলে তারা পিএসটিএন কোম্পানী টিকিয়ে রাখতে পারছিল না। তাদের এই প্রসত্মাব বিটিআরসি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। এরপর তারা বেপরোয়া হয়ে ভিওআইপি করছিল। এখনও অনেক আইএসপি, ভি-স্যাটের মালিক ও পিএসটিএন কোম্পানি ভিওআইপির সঙ্গে জড়িত বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। টেলিকম বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের দুটি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি), বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও ম্যাংগো টেলিসার্ভিস লিমিটেড বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ডিপ প্যাকেট ইনিস্পেশন (ডিপিআই) পদ্ধতি ব্যবহার করে বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার (আইএসপি) এর ডাটা ট্রাফিক সার্বণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ডিপিআইএর মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি কাজে ব্যবহৃত আইপি গুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আইআইজি দ'ুটির ডাটা ট্রাফিক অনলাইনে পরিবীণ করার জন্য বিটিআরসিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। গত এক বছরে এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৫০০০ (পনেরো হাজার) আইপি ঠিকানা বন্ধ করা হয়। অনেক আইপি এখন বিটিআরসির সন্দেহের দৃষ্টিতে রয়েছে। বর্তমানে বিটিসিএল, মীর টেলিকম লিমিটেড, বাংলাট্রাক লিমিটেড, ম্যাংগো টেলিসার্ভিস লিমিটেড আইজিডবিস্নউ লাইসেন্সপ্রাপ্ত গেটওয়ে। এসব কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশী কল দেশে আসাই হচ্ছে বৈধ চ্যানেল। এর বাইরে কোনভাবে কল আসলে সেগুলোই অবৈধ কল। বর্তমানে ভিওআইপি ব্যবসা হেরোইন বা সোনা চোরাচালেনর চেয়ে বড় ব্যবসা হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। এখান থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা কিছু সংখ্যক মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, র‌্যাংকসটেলের চেয়ারম্যান রউফ চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী জাকিয়া রউফ চৌধুরী, ছেলে রমু রউফ চৌধুরী, মেয়ে সোহানা চৌধুরী, র‌্যাংকসটেলের উর্ধতন কর্মকর্তা করিম ইকবাল ভুইয়া, এসকে কামরম্নজ্জামান, মমিনউল্লাহ চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন, আশরাফ উদ্দীন, ফজলে সেলিম, একেএম শামসুউদ্দীনকে আসামী করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে বিটিআরসি। আসামিদের মধ্যে করিম ইকবাল ভুইয়া, এসকে কামরম্নজ্জামান ও মমিনউলস্নাহ চৌধুরীকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতারের পর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। ওইদিন রাতেই র‌্যাংকসটেলের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় অবস্থিত সুইচিং সেন্টার সিলগালা করে দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.