হাত বাড়িয়ে দিন by নজরুল হোসেন

কৈশোর বা বয়োসন্ধিকালীন দ্রুত শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন শিশুদের নানাভাবে চিন্তিত ও প্রভাবিত করে। সোজা কথায় বললে ‘স্বপনদোষ কোন দোষ নয়, একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া, এটি আমরা সবাই জানি।
কিন্তু ‘স্বপ্ন’ নামের সঙ্গে ‘দোষ’ শব্দটি যুক্ত থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই একে কিশোর-কিশোরীদের মাঝে ভীতিকর মনে হতে পারে। এ ধরনের ভীতি দূর করতে একে ‘স্বপ্নপাত’ বা অন্যকিছু বলা যেতে পারে।
কিশোর বয়সে নিজের অজান্তেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ করা স্বাভাবিক। এমনটি হলে নিজেকে অপরাধী ভেবে মন খারাপ করা উচিত নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণী ইচ্ছা করলেই যৌন সম্পর্ক করতে পারে কিন্তু মানুষ তা পারে না। এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মানুষকে কিছু ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের মাধ্যমে যেতে হয়।
কৈশারকালীন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন শিশুদের নানাভাবে চিন্তিত ও প্রভাবিত করে। এই সময়টাতে শিশুরা অতি অনুসন্ধিৎসু এবং আত্মজিজ্ঞাসামূলক অসংখ্য অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করে। নিজেদের বিশেষ কতক শারীরিক পরিবর্তন; যেমন যৌন উত্তেজনা, স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত, লিঙ্গবিষয়ক চিন্তা, মাসিক, স্তন্যবিষয়ক, নেশা বিষয়ে তারা অজানা আশঙ্কায় শিহরিত হয়, আবার মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সবার আড়ালে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রতিনিয়ত জানার চেষ্টা করে।
আমাদের দেশে যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই সমস্ত বিষয় কিশোর- কিশোরীদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয় না আর তাই অপেক্ষাকৃত বয়স্ক বন্ধুদের সংস্পর্শে আকৃষ্ট হয় এবং নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ চটি বই এবং যৌন উত্তেজক যেকোন বিজ্ঞাপন, সিনেমা বা বইয়ের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ কারণে শিশুদের পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা আমাদের দেশে বেড়েই চলেছে।

বয়োসন্ধিকাল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০-১৯ বছরের মধ্যবর্তী সময় বা বয়সটিকে কৈশোরকাল বলে। ১০ বছরের নিচের বয়সটিকে ‘শিশু বয়স’ এবং ১৯ বছরের পরের বয়সটিকে ‘পূর্ণাঙ্গ’ বয়স বলে। এই দুই বয়সের মাঝের বয়সটি শিশু ও পূর্ণাঙ্গ বয়সের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে; তাই একে বয়োসন্ধিকালে বলে। এ সময়টাতে ছেলেমেয়েদের ভিন্ন রকমের শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন হয়। আর তাই তারা প্রজননক্ষম হয় এবং এক ধরনের অজানা আশঙ্কার মধ্যে বেড়ে ওঠে।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ বয়সের ছেলেমেয়ের স্বাস্থ্য সমস্যা, মানসিক পরিবর্তন ও আচরণগত পরিবর্তন সম্পর্কে জানার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে এ ধরনের কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সে রকম প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বল্পপরিসরে হলেও কৈশোর স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও এটা আরও ব্যাপকভাবে শুরু করা প্রয়োজন। আমাদের অভিভাবকরাও এ বিষয়গুলোর ওপর ভাল বই তাদের সন্তানদের পড়তে বলতে পারেন বা নিজেরা তা পড়ে
সন্তানদের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।

বয়োসন্ধিকালে ছেলেদের শারীরিক পরিবর্তন
কৈশোরে ছেলেদের দেহ ও মনে অনেক পরিবর্তন হয় এবং তারা তার ফলে প্রজননক্ষম হয়। সচেতনতার সঙ্গে কৈশোরকালীন পরিবর্তণকে সাস্থ্যসম্মতভাবে মোকাবেলা করলে অনেক কষ্ট থেকেই লাঘব সম্ভব।
১। দাড়ি-গোঁফ গজায়।
২। বগলে ও প্রজনন অঙ্গের গোড়ায় লোম গজায়।
৩। দ্রুত উচ্চতা ও ওজন বাড়ে।
৪। হাত-পায়ের লোম গাঢ় হয়, বুকে লোম ওঠে।
৫। চিকন গলার স্বর/ কণ্ঠস্বর মোটা বা ভারি হয়।
৬। ঘাম বেশি হয় এবং ত্বক তেলতেলে হয়।
৭। বুক ও কাঁধ চওড়া হয়। শরীর বিশেষত হাত ও পা পেশীবহুল হয়।
৮। মুখে ব্রণ উঠতে পারে।
৯। শরীরের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
১০। প্রজনন অঙ্গ অর্থাৎ লিঙ্গ বড় হয়।
১১। যৌন চিন্তা হয় ও যৌন উত্তেজনা হলে লিঙ্গ শক্ত হয়ে যায় এবং চুলকানি হয়।
১২। অধিকাংশ সময় ঘুমানোর সময় বীর্যপাত হয়।

বয়োসন্ধিকালে মেয়েদের
শারীরিক পরিবর্তন
বয়োসন্ধিকালে মেয়েদের যে যে শারীরিক পরিবর্তন হয় এবং পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় তারা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে এবং কখনও কখনও আতঙ্কগ্রস্তও হয়ে পড়ে। এ সময় বড়রা কিশোরীদের সহযোগিতা করতে পারে।
১। মেদ বৃদ্ধি পায়।
২। স্তন বড় হয়।
৩। কোমর সরু, উরু ও রান ভারি হওয়াসহ কোমরের পেছনের হাড় চওড়া হয়।
৪। ঘাম বেশি হয়।
৫। গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে।
৬। শরীরের বিভিন্ন অংশে চুল গজায়। যেমন বড়লে, যোনি অঞ্চলে।
৭। সব স্থায়ী দাঁত উঠে যায়।
৮। যৌনাঙ্গ, জরায়ু এবং ডিম্বকোষ বড় হয়।
৯। মাসিক বা ঋতুস্রাব শুরু হয়।
ছেলেদের মানসিক পরিবর্তন
* মেয়েদের প্রতি অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারে।
* এ সময় ছেলেরা কেউ কেউ ঘরকুনো হয়।কেউ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে গোপনে আলাপ করতে পছন্দ করে।
* যৌন বিষয়ক চিন্তায় অতি আগ্রহ দেখা দেয়ার ফলে কেউ আবার হস্তমৈথুন শুরু করে এবং কারও কারও ক্ষেত্রে তা মাত্রাতিরিক্ত হতে পারে।
* ঘুমের মধ্যে বীর্যপাত হওয়া, যাকে স্বাভাবিকভাবে স্বপ্নদোষ বলে, যদিও এটা কোন দোষ নয়। এ বয়সে কেউ আবার স্বপ্নদোষ নিয়ে নানা কাল্পনিক রোগে ভোগে এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

মেয়েদের মানসিক পরিবর্তন
* মেয়েরা ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে।
* ঘন ঘন মানসিক পরির্বতন হয়ে থাকে।
* দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, হতাশা, চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয় ও মনে নানা প্রশ্ন জাগে।
* কেউ কেউ একা থাকতে পছন্দ করে আবার কেউ বা অনেক বন্ধু- বান্ধবের সঙ্গে থাকতে ভালবাসে।
* স্বাধীন ও স্বনির্ভর হবার ইচ্ছা জাগে।
* কাল্পনিক অসুখ-বিসুখে ভোগে।
* যৌন চিন্তার প্রবণতা আসে।
* অপমান ও লজ্জাবোধ প্রবল হতে থাকে।
* আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার কারণে মেয়েদের লজ্জা বেশি হয় এবং অনেক সময় অতিমাত্রায় ঘরকুনো হয়ে পড়ে।
* যৌন বিষয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে ভয়-ভীতি জন্মাতে পারে।

ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
১। নিয়মিত গোসল।
২। হাত ধোয়া
৩। নখ কাটা।
৪। দাঁত পরিষ্কার রাখা।
৫। চুলের যতœ নেয়া।
৬। পায়ের যতœ নেয়া।
৭। চোখ, কান ও নাকের যতœ নিতে হবে।
৮। ত্বক বা চামড়ার যতœ।
৯। পরিষ্কার জাঙ্গিয়া পরা।
১০। যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখা।
১১। বগল এবং যৌনাঙ্গের চুল কাটা।
১২। স্বপ্নপাতের পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে পরিষ্কার কাপড় পরা।

No comments

Powered by Blogger.