স্বাধীনতার ঘোষক তত্ত্ব by মেজবাহউদ্দিন জওহের

তত্ত্ব বা থিওরি বিজ্ঞানশাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি শব্দ যা সাধারণত অগ্রজ বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করে থাকেন। তবে কেবল বিজ্ঞানীরাই এর একচেটিয়া অধিকার ভোগ করবে- অন্য কারও কিছু করার থকবে না তা মেনে নেয়া যায় না।
পলিটিক্যাল নেতানেত্রীরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন। হিসেব করলে দেখা যায়, তত্ত্ব উদ্ভাবনে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী নেতানেত্রীরা অন্যদের চাইতে অনেক এগিয়ে আছেন। হালফিলের জাতীয়তাবাদী তত্ত্বসমূহের মধ্যে যেগুলো উল্লেখযোগ্য সেগুলো হলো- সাকা চৌধুরীর 'কুকুরের লেজ নাড়া তত্ত্ব', প্রয়াত সাইফুর রহমান সাহেবের 'খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন দেশের অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর' শীর্ষক তত্ত্ব, দেশনেত্রীর 'জন্মদিন সঞ্চালন তত্ত্ব' এবং জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের উদ্ভাবিত 'স্বাধীনতার ঘোষক তত্ত্ব'। যেহেতু এখন মার্চ মাস চলছে, সুতরাং আজকের লেখাটিতে স্বাধীনতার ঘোষক তত্ত্ব নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করা যায়।
এ তত্ত্বটি প্রপোজ করা হয় ৯১-৯৬ সময়কালে, ম্যাডাম জিয়ার প্রথম মেয়াদে। এ তত্ত্বে প্রস্তাব করা হয় যে, শেখ মুজিব নয়, মেজর জিয়াই একাত্তরের সাতাশে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেই সুবাদে মেজর জিয়াই হচ্ছেন স্বাধীনতার মহান ঘোষক! নাম না জানা এক অখ্যাত মেজরের ডাকেই নাকি বাঙালীরা পাগলের মতো স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দেশটাকে স্বাধীন করে ফেলে! এ তত্ত্বের একটি মারাত্মক ছিদ্র ছিল, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যার নাম 'লুপ-হোল'। যখন প্রশ্ন করা হতো যে জিয়াই যদি স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে থাকেন এবং ২৭ মার্চ ঘোষণাটি দিয়ে থাকেন, তা'হলে স্বাধীনতা দিবস তো ২৭ মার্চ হওয়ার কথা। তা না হয়ে ২৬ মার্চ হলো কেন? এই বোয়াড়া প্রশ্নের কোন তাৎক্ষণিক জবাব জাতীয়তাবাদীদের ছিল না। এমন প্রশ্নের মুখে অনেক ঝানু ঝানু জাতীয়তাবাদীকেও খামোশ হয়ে তর্কযুদ্ধ হতে তড়িঘড়ি পিছু হটতে দেখা গেছে। এর প্রতিবিধান কিভাবে করা যায়, তা ভাবতে ভাবতেই সেবারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ছিয়ানব্বইর নির্বাচনে ক্ষমতাচু্যত হলে ঘোষণা তত্ত্বটি সাময়িকভাবে ঝুলে যায়। এলো ২০০১ সাল। বিখ্যাত লতিফীয় নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর তাদের মনে হলো যে অবস্থার পার্মানেন্ট একটি সুরাহা করা দরকার। লতিফের আশীর্বাদে তারা সাংবিধানিকভাবে যা খুশি তাই করার ক্ষমতা রাখে, দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটির জোরে সংবিধান পরিবর্তন করে তারা যদি ঘোষণা দেয় যে বাংলাদেশের সবাই মহিলা প্রজাতির জীব তা'হলেও কারও বলার কিছু নেই। এমতাবস্থায় ভবিষ্যতে আর যেন কোন অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি না হতে হয় তা নিরসনকল্পে তারা ঘোষণার দিনটি একদিন এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিল। ঘোষণা দিল-২৭ মার্চ নয়, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরই জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিয়েছিলেন! এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দিন তারিখ সুবিধামতো এগিয়ে নিয়ে আসাটা জাতীয়তাবাদী অভিধানে দোষের কিছু নয়। তাদের আপোসহীন নেত্রী ইতোমধ্যেই 'জন্মদিন সঞ্চালন তত্ত্ব'র মাধ্যমে নিজের জন্ম তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ আগস্ট এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। সুতরাং ২৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এগিয়ে নিয়ে আসলে তেমন দোষের কি আছে? মুশকিল হলো জিয়ার আমলে লিখিত এবং হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক সংকলিত স্বাধীনতার দলিলপত্রগুলো। সেগুলোতে যে প্রকৃত তথ্য সংরক্ষিত আছে। সিদ্ধান্ত হলো- পুরনো ইতিহাস সংশোধন করে নতুনভাবে লিখতে হবে। সুতরাং হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত সমস্ত দলিলপত্র বাজেয়াফত করে ২০০৩ সালে নতুনভাবে স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হলো এবং নব-উদ্ভাবিত ঘোষক তত্ত্বকে রাষ্ট্রীয় দলিলপত্রে সন্নিবেশিত করা হলো।
ঘোষণাটি যে জিয়া ২৭ মার্চ বিকেলে দিয়েছিলেন ২৫ মার্চ নয়, একথা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ বিষয়ে অতীতে এত বেশি লেখালেখি হয়েছে যে এর ওপর আর কিছু আলোচনা করা সময়ের অপচয় মাত্র। তবুও তরুণ প্রজন্মের মনে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসটি বদ্ধমূল করার জন্য বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিনগুলোতে বিষয়টির ওপর আলোচনা হওয়া জরুরী। এ বিবেচনা থেকেই কিছু বাছাই করা প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে এই প্রবন্ধটি সাজানো হলো।
একটি জাতির স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধ কর্তৃত্ব উক্ত জাতির কোন সর্বজনস্বীকৃত নেতার হাতেই সংরক্ষিত থাকে, আর কারও হাতে নয়। একাত্তরে বাংলাদেশের জাতীয় নেতা ছিলেন- মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। বয়স ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ভাসানী অনেক সিনিয়র ছিলেন, শেখ মুজিব এক সময়ে মওলানার সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুজিব তাঁর রাজনৈতিক মুরব্বিকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের মানুষের মনে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ-বিদেশে মুজিবের ইমেজ এতটাই গগনচুম্বী হয়ে দাঁড়ায় যে মুজিব ও বাংলাদেশ সমার্থক হয়ে যায়। 'এক নেতা এক দেশ-বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ'-ঊনসত্তর-সত্তরে এটাই ছিল বাঙালী জনগণের সর্বজনপ্রিয় স্লোগান। সত্তরের নির্বাচনে মুজিবের দল আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সব দল বলতে গেলে পূর্ব বাংলার মাটি হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। উক্ত নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে মুজিব বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র বৈধ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত নিয়ে মুজিবের সঙ্গেই আলোচনা চালিয়ে যায়। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মুজিবই ছিলেন পূর্ব বাংলার ডি-ফ্যাক্টো শাসক। পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গবর্নর হাউসে নামকাওয়াস্তে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একজন গবর্নর ছিল, মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে ছিল একজন মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ছিল মুজিবের হাতে। তাঁরই নির্দেশে সরকারী অফিস চলত, তাঁরই নির্দেশে কর্মচারীরা বেতন পেত, তাঁরই নির্দেশে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হতো। এমনকি সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্টগুলোও পরিচালিত হতো তাঁরই নির্দেশে। বিদেশী পত্রপত্রিকায় এমন রিপোর্টও তখন ছাপা হয়েছে যে 'ঢাকা শহরে একমাত্র গবর্নর হাউস ও ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে না, কোথাও পাকিস্তানের শাসন কার্যকর নেই। পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনক্ষমতা এখন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কে'।
এমন একটা অবস্থায় মুজিবের মুখনিঃসৃত কোন নির্দেশ ছাড়া আর কারও নির্দেশ বাঙালীরা মানবে না, বিশ্ববাসীর কাছে তা বৈধ বলেও বিবেচিত হবে না- একথা পাগলেও বুঝতে পারে। তাই দেখা যায়-বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জনসভার কয়েকদিন পর মওলানা ভাসানী পল্টনে এক জনসভা করেন। উক্ত জনসভায় মওলানা ভাসানী মুজিবকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার উদাত্ত আহ্বান জানান, বলেন- 'মুজিব আর দেরি নয়, অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করো'। অর্থাৎ কাঙিক্ষত ঘোষণাটির জন্য মওলানাকে তারই এককালের সাগরেদের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে, তিনি নিজে ঘোষণাটি দিতে পারছেন না। কারণ তিনি জানতেন, তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধ এখতিয়ার কেবল মুজিবেরই আছে, আর কারও নয়। আর কেউ ঘোষণাটি দিলে শুধু যে বাংলাদেশের মানুষের কাছেই তা গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হবে তাই নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও তার কোন লিগাল স্ট্যান্ডিং থাকবে না। এমতাবস্থায় প্রায় চল্লিশ বছর পর কেউ যদি দাবি করে বসে যে ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন নিবেদিতপ্রাণ মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন, হঠাৎ করেই তার মনে দেশপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে ওঠে এবং তিনি বেতার মারফৎ একটা ঘোষণা দেয়ার ফলেই জনগণ পাগল হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দেশটিকে স্বাধীন করে ফেলে- এরূপ দাবিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন উন্মাদের প্রলাপ ছাড়া আর কোন বিশেষণে বিভূষিত করা যায়?
২৫ মার্চ তিনি গ্রেফতার হতে যাচ্ছেন- এ সংবাদ মুজিব পূর্বাহ্নেই টের পান এবং তাঁর সহকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি বহুপ্রতীক্ষিত স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিয়ে যান। কীভাবে এ ঘোষণাটি ঢাকা হতে বাইরে পাঠানো হয়েছিল, এ প্রেরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে কারা কারা জড়িত ছিল- তার বিস্তারিত বিবরণ গত ঊনচল্লিশ বছর ধরে পত্রপত্রিকায় বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে এখনও জীবিত (যেমন তৎকালীন মগবাজারস্থ ভিএইচএফ কন্ট্রোল স্টেশনে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভাইজার মেজবাহউদ্দিন, রেডিও টেকনিশয়ান আবদুল হামিদ ও ফিরোজ কবির, চট্টগ্রামের সেলিমপুরস্থ ওয়ারলেস স্টেশনে কর্মরত আবদুল কাদের, মাহফুজ, জুলহাস প্রমুখ কর্মচারী-কর্মকর্তাবৃন্দ। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য পড়ুন দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন চট্টগ্রাম সংবাদদাতা মইনুল আলমের স্মৃতিচারণমূলক জবানবন্দী 'যে কথা আজও বলিনি', প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায়-১৯৭৩ সালে। স্মর্তব্য-সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে তখন, স্মৃতি এবং দেশপ্রেম একদম টাটকা-টগবগে। রাজনীতির কলুষতা মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেনি তখনও, বাঙালী জাতির এমন বেদনাদায়ক বিভক্তির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি সেদিন। লেখক তাই সেদিনকার ঘটনার অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য এবং তথ্যনির্ভর বর্ণনা দিতে পেরেছেন তাঁর লেখায়। ২৬ তারিখ সকালে বঙ্গবন্ধুর মেসেজটি কীভাবে ঢাকার মগবাজার ওয়ারলেস স্টেশন হতে ছিলিমপুরের কোস্টাল স্টেশনের কর্মচারীরা রিসিভ করে, কীভাবে সেটা চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রেরণ করা হয়, কীভাবে তা হ্যান্ডবিলের আকারে রাস্তায় রাস্তায় বিলি করা হয়, কীভাবে তা ক্যালকাটা শিপিং কন্ট্রোলের কাছে পাঠানো হয়, কীভাবে তা বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত ভারতীয় জাহাজ ভিভি গিরি এবং আমেরিকান জাহাজ এমভি সালভিস্টার কাছে পাঠানো হয়, কীভাবে ভয়েস অব আমেরিকা ঐদিন রাত দশটার খবরে প্রচার করে যে, বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, শেখ মুজিব এক অজ্ঞাত স্থান থেকে দেশটির স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন- সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে লেখাটিতে)। তাদের অগণিত রচনা, স্মৃতিকথা, অডিও ভিডিও সাক্ষাতকার ইত্যাদিতে বিষয়টি চিলকালের জন্য প্রমাণিত হয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধুর উক্ত ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই চট্টগ্রাম বেতারে কর্মরত বেতারকর্মী আবুল কাশেম সন্দীপ, বেলাল মোহাম্মদ, প্রকৌশলী আব্দুশ শাকের, প্রকৌশলী শরফুজ্জামান প্রমুখ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র হতে ঘোষণাটি প্রচারের উদ্যোগ নেন এবং ২৬ তারিখ দুপুরের মধ্যেই প্রয়াত আবদুল হান্নান বাণীটি কালুরঘাট রেডিও স্টেশন হতে পাঠ করেন। একজন আর্মির লোক দ্বারা ঘোষণাটি পাঠ করানো গেলে জনগণ দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হবে-এ ধারণায় বেতার কর্মীগণ একজন আর্মি পার্সোনেলের খোঁজ করতে থাকেন। এ প্রক্রিয়ায় তারা প্রথমে মেজর রফিকের (বীরউত্তম) শরণাপন্ন হন। মেজর রফিক পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণে কালুরঘাট যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বেতার কর্মীরা তখন ষোলশহরে অবস্থানরত আরেকজন আর্মি অফিসারের খোঁজ পান (মেজর জিয়া)। বেলাল মোহাম্মদদের আমন্ত্রণে জিয়া কালুরঘাট আসেন এবং ২৭ তারিখ বিকেল ৭-৪০ মিনিটে প্রথমবারের মতো তা পাঠ করেন। বেলাল মোহাম্মদ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের লেখায় এ ঘটনাটির বিস্তৃত বিবরণ জাতীয় সংবাদপত্রে ও অন্যান্য মিডিয়ায় বহুবার প্রচারিত হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রথীমহারথীরা যাঁরা মেজর জিয়ার কথিত ঘোষণাটির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন- এ প্রসঙ্গে অতীতে তাঁরা কী বলেছেন সেদিকে একবার একটু চোখ বুলানো যাক।
* সাবেক বিএনপি নেতা কলি তার "আমার সংগ্রাম আমার রাজনীতি' নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে লিখেছেন- 'সব কিছু চিন্তা ভাবনা এবং পর্যালোচনার পর আমরা সুপরিকল্পিতভাবে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করলাম। মেজর জিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৭ মার্চ বিকেল বেলা দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। আমি তাঁর পাশেই বসা ছিলাম।"

* বিএনপি নেতা মীর শওকত আলী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন- 'বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা যেটা নিয়ে সব সময় বিতর্ক চলতে থাকে জেনারেল জিয়া করেছিলেন না আওয়ামী লীগ থেকে করেছে। আমার জানা মতে, সবচাইতে প্রথম বোধ হয় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান ভাইয়ের কণ্ঠই লোকে প্রথম শুনেছিল। এটা ২৬ মার্চ ১৯৭১ অপরাহ্ন দু'টার দিকে হতে পারে। কিন্তু চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রেরকযন্ত্র খুব কম শক্তিসম্পন্ন ছিল, সেহেতু পুরো দেশবাসী সে কণ্ঠ শুনতে পাননি। কাজেই যদি বলা হয়, প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল, তা'হলে আমি বলবল যে হান্নান ভাইয়ের সেই বিদ্রোহী কণ্ঠ। তবে এটা সত্য যে, পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ '৭১ মেজর জিয়ার ঘোষণা প্রচারের পরই স্বাধীনতা যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়'। (পাঠক, একবার ভাবুন তো! হান্নান ভাইয়ের ঘোষণার সময় প্রেরক যন্ত্রের ক্ষমতা কম থাকাতে খুব কম লোকেই তা শুনতে পেল। কিন্তু পরদিন মেজর জিয়া যখন সে একই যন্ত্রে ভাষণ দিলেন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব লোকেই তা শুনতে পেল এবং মুক্তিযুদ্ধ গুরুত্বপুর্ণ মোড় নিল! এটি কি চরম হাস্যকর ও পরস্পরবিরোধী যুক্তি নয় পাঠকবৃন্দ)। (চলবে)

লেখক : সৌদি আরব প্রবাসী
e-mail: mezbahjowher@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.