চেতনার মহাজাগরণ

একাত্তরের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় ঘোষিত হওয়ার পর পরই আশাভঙ্গের বেদনায় ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে রাস্তায় নেমে আসে।
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তারা প্রমত্ত টাইফুনের মতো ফুঁসে ওঠে। রাজধানীর শাহবাগ চত্ব¡রকে প্রজন্ম চত্ব¡র নাম দিয়ে তারা এক অভাবনীয় আত্মপ্রত্যয় আর প্রতিবাদের প্রকাশ ঘটায়। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে মুখরিত শাহবাগ চত্বরের চিরচেনা সেই অবয়ব মুহূর্তে পরিণত হয় এক সংগ্রামমুখর তেজোদীপ্ত চেহারায়; ঐক্য, শক্তি ও মহাজাগরণের এক অবিস্মরণীয় প্রতীকে। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করেছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, সব বয়সের নারী-পুরষ। এদের মধ্যে আছেন বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক-লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। এমনকি অভিভাবকদের সঙ্গে এসেছে শিশুরাও। তাদেরও মুখে ধ্বনিÑ জয় বাংলা, রাজাকারের ফাঁসি চাই ইত্যাদি সেøাগান। এই মহাজমায়েতে শুধু ঢাকার মানুষ নয়, ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকেও সব বয়সের মানুষ এসে যোগদান করছেন। প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, প্রাণের টানে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়, এমনকি বিদেশেও ব্যাপকসংখ্যক বাঙালী প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। তাঁরাও মিছিল-সমাবেশে সমবেত হয়ে গগনবিদারী আওয়াজ তুলছেনÑ রাজাকারের ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই।
ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল অগণিত মানুষের এই যে মহাজাগরণ তা বাঙালীদের নতুন শক্তিতে প্রত্যয়ী করে তুলেছে। এই উত্তাল জনজোয়ার কিছুটা আকস্মিক এবং অভাবনীয় হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ ওই প্রতিশ্রুতির সপক্ষে ভোট দেয় এবং নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ নির্বিঘেœ এগিয়ে চলছিল। ইতোমধ্যে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছে। এতে সেই তরুণ সমাজ এবং বিচারপ্রত্যাশী অন্যরা রায়ে তাঁদের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে পেয়ে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায়ে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েন। আর সেই হতাশার মধ্য থেকেই হঠাৎ করে জ্বলে উঠেছে প্রতিবাদ ও ক্ষোভের আগুন। এই আগুন তাদের আকাক্সক্ষা পূরণ না হওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত বহির্প্রকাশ; আত্মশক্তিতে অটল থেকে দাবি আদায়ের হিমাদ্রিকঠিন সঙ্কল্পের স্মারক।
তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রজন্ম চত্ব¡রের মহাজাগরণ এবং সারা দেশের প্রতিবাদ-সমাবেশে তারুণ্যের উত্থান থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নেয়ার আছে আমাদের। মহাজাগরণ সুস্পষ্টভাবে এই বার্তাই সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছে যে, একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতকদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগী-সমর্থক গোষ্ঠী যতই হম্বিতম্বি আর সন্ত্রাস-নৈরাজ্য চালিয়ে দেশকে অচল করে দেয়ার পরিকল্পনা করুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত মানুষ, বিশেষ করে অকুতোভয় তরুণ প্রজন্ম এই অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে এখনও যারা দ্বিধান্বিত; তাদের সমর্থন দিয়ে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের বাস্তবতাকে কলুষিত করছেন, তাঁরাও এ থেকে সতর্ক সংকেত পেতে পারেন।
ছাত্র-জনতার এই মহাজাগরণের মহাঐক্য অটুট থাকুক, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হোক এই প্রত্যাশা আজ সমগ্র জাতির।

No comments

Powered by Blogger.