এ্যাজমা ও এ্যালার্জি রোগীর ভ্রমণকালীন কিছু টিপস

এ্যাজমা ও এ্যালার্জির রোগী মাত্রই জানেন যে, এ রোগ তাদের সার্বক্ষণিক সাথী। এমনকি ভ্রমণকালেও। সুতরাং ভ্রমণ শুরুর আগে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলে তার ভ্রমণ হতে পারে দুশ্চিন্তামুক্ত।
বাস, ট্রেন, ট্যাক্সিতে ভ্রমণ : এ ধরনের যানবাহনে চলাচলের সময় বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী এ্যালার্জি উৎপন্নকারী উপাদানের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন ধূলিকণা, ছত্রাক এবং বিভিন্ন উদ্ভিদের পুষ্পরেণু। এ ধরনের বাহনের কার্পেট, আসনের গদি এবং বাতাস চলাচলের জানালাগুলোতে সঞ্চিত থাকে ধুলো এবং ছত্রাক। এ ধরনের বাহনে চলাচল করার সময় এ্যালার্জি ও এ্যাজমা রোগীদের উচিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় ভ্রমণ করা। বিশেষ করে তা যদি হয় দীর্ঘ ভ্রমণ। গাড়িতে ওঠার পূর্বে গাড়ির দরজা-জানালা ১০ মিনিট খুলে রাখলে ধুলো ও ছত্রাকের পরিমাণ অনেক কমে যায়।
গাড়ির বাইরেও অনেক ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে থাকে ধুলো এবং ছত্রাক, বিশেষ করে যদি গাড়ির জানালা খোলা থাকে। সেক্ষেত্রে জানালা বন্ধ রাখাই উত্তম।
সিগারেটের ধোঁয়া এবং বাতাসের দূষণ রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটায়। সে কারণে খুব ভোরে বা বেশি রাতে ভ্রমণ করা ভাল। কারণ এ সময়ে বায়ুদূষণ কম থাকে আর একই সঙ্গে রাস্তায় ভিড়ও কম থাকে। রোগী যদি নেবুলাইজার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে সহজে বহনযোগ্য নেবুলাইজার সঙ্গে নেবেন।
বিমানে ভ্রমণ : বিমানের অভ্যন্তরীণ বাতাস এ্যাজমা ও এ্যালার্জিক রোগীর ওপর প্রচ- প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ বিমানকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, তবে আন্তর্জাতিক রুটে ধূমপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয়। সেক্ষেত্রে বিমানে সিট নেবার সময় চেষ্টা করতে হবে ধূমপান থেকে যত দূরে সম্ভব সিট রিজার্ভ করা।
যদি আপনি এ্যাজমাতে খুব বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন, যদি অক্সিজেন নেবার প্রয়োজন হয় মাঝে মাঝে, তাহলে বিমান ৩৫০০০ ফিট উপরে উঠলে আপনার অক্সিজেনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে বিমান কর্তৃপক্ষের সাথে এ ব্যাপারে আপনার পূর্বাহ্নে আলোচনা করে রাখা উচিত।
আপনার যদি কোন খাবারে এ্যালার্জি থাকে তাহলে বিমানে খাওয়ার সময় আপনাকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। যেহেতু বিমানে খাবার আসে সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে, সে কারণে বিমানের কেউই আপনাকে সঠিকভাবে জানাতে পারবে না যে, খাদ্যে কি কি উপাদান আছে। সে কারণে আপনার কাছে এপিনেফ্রিন ইঞ্জেকশন রাখতে হবে। বিমানে তীব্র এ্যালার্জিতে আক্রান্ত হলে এ ইঞ্জেকশন কাজে লাগবে। আপনার যদি সাইনোসাইটিস কিংবা কানে কোন সংক্রমণ থাকে তাহলে বিমান পথে আপনি তীব্র ব্যথা অনুভব করতে পারেন। তাই প্রথমে চেষ্টা করুন আপনার এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ করার, পরে বিমান ভ্রমণ করুন। আর অসুখ নিয়েই যদি আপনাকে বিমানে উঠতে হয়, তাহলে বিমানে ওঠার সময় এক ঘণ্টা আগে নাকে প্রদাহরোধী স্প্রে করুন বা একই ধরনের ওষুধ খেতে পারেন। বিমানের ভেতরে বাতাস খুবই শুষ্ক। সে কারণে প্রতি ঘণ্টায় নাকে স্যালাইন স্প্রে করলে নাকের ভেতরের ত্বক আর্দ্র থাকবে।
জাহাজে ভ্রমণ : এ্যাজমা কিংবা এ্যালার্জির রোগী হলে জাহাজে সিট বুক করার আগেই জেনে নিন জাহাজে কি কি চিকিৎসা সুবিধা আছে এবং কারা যাত্রীদের স্বাস্থ্যরক্ষার কাজে নিবেদিত। তবুও আপনি এ্যালার্জির রোগী হলে সাথে অবশ্যই এপিনেফ্রিন ইঞ্জেকশন নেবেন।
আপনার যদি একজিমা থাকে, তাহলে পানি ও সূর্যের আলোতে উন্মুক্ত হলে তা বেড়ে যাবে। তাই অবশ্যই প্রদাহরোধী মলম সঙ্গে নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, যাত্রাকালে আপনি ভিন্ন ধরনের জলবায়ু এবং ঋতুর মুখোমুখি হতে পারেন। উষ্ণম-লীয় ও আর্দ্র আবহাওয়ায় আপনি বিভিন্ন পরজীবী, বায়ুবাহিত ছত্রাক এবং মৌসুমী পুষ্পরেণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। অন্যদিকে ঠা-া, স্যাঁতসেতে আবহাওয়ায় আপনি মুখোমুখি হবেন ধুলোর সঙ্গে মিশে থাকা পরজীবী এবং ছত্রাকের। শুষ্ক আবহাওয়ায় ঠা-া বাতাসও আপনার এ্যাজমার প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
এ্যালার্জি উৎপাদক উপাদানের উৎস : ভ্রমণে বেরিয়ে অনেকেরই হোটেলে থাকতে হয়। হোটেলের ঘরগুলোতে বিশেষত ঘরের কার্পেট, মাদুর, পাপোস এবং আসবাবে থাকে প্রচুর পরিমাণে ধূলি, পরজীবী এবং ছত্রাকÑযা আপনার এ্যাজমা ও এ্যালার্জির প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
অনেক দেশে ভাল হোটেলে এ্যালার্জি প্রুফ কক্ষ থাকে। সম্ভব হলে সে রকম কক্ষ নেবেন। তা না পেলে আপনি ছত্রাক থেকে বাঁচতে হলে এমন কক্ষ বেছে নিন যেখানে প্রচুর রোদ প্রবেশ করতে পারে। সুইমিংপুল থেকে যতদূরে থাকা যায় তত ভাল। ঘরে যাতে কোন বিড়াল বা ইঁদুর ঢুকতে না পারে কর্তৃপক্ষকে সে ব্যবস্থা করতে বলুন। সে সঙ্গে চাদর ও বালিশের কভার নিজের হলে ভাল হয়।
যদি ঘরটি সমুদ্র তীরবর্তী হয়ে থাকে, তাহলে প্রবেশের আসে কিছুক্ষণের জন্য ঘরটির দরজা জানালা খুলে দিয়ে রাখতে বলুন।
পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত : অনুষ্ঠানের সময় বাড়ির পরিবেশ এ্যালার্জি উৎপাদনে সহায়ক হয়ে যায়। খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস ট্রি তো পরজীবী ছত্রাকের অন্যতম আবাসস্থল। বাড়ির পোষা প্রাণীদের লোম, লালা, প্রসাবে প্রচুর ছত্রাক থাকতে পারে। সুতরাং আপনার এ্যালার্জি বা এ্যাজমা থাকলে যেসব আত্মীয়ের পোষা প্রাণী আছে সেসব বাড়িতে অবস্থান না করার চেষ্টা করবেন।
যাদের খাবারে এ্যালার্জি হয় তারা অনুষ্ঠানের বা পার্টির খাবার এড়িয়ে চলবেন। কেননা বিভিন্ন খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে এ্যালার্জি উৎপাদক উপাদান থাকতে পারে।
পুষ্পরেণুজনিত এ্যালার্জি থাকলে সেসব মৌসুমে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন। তখন পুষ্পরেণু বেশি বেশি বাতাসে ভেসে বেড়ায়। মূলকথা হলো যদি কোন আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে অবস্থান করতে চান, তাহলে তাকে পূর্বাহ্নেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কথা বিস্তারিত জানান।
নতুন অভিজ্ঞতা : অনেকেরই ক্যাম্প করার ইচ্ছা থাকে। কিন্তু এই তাঁবু বাস আপনাকে নানা ধরনের পুষ্পরেণুর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এনে দেয়। তদুপরি মৌমাছি, হলুদ পোকা ও বিভিন্ন পতঙ্গের কামড়ের ব্যাপার তো আছেই। যাদের এ্যালার্জি আছে তারা যে মৌসুমে বাতাসে পুষ্পরেণু বেশি থাকে, সে মৌসুমে তাঁবু বাস থেকে বিরত থাকবেন। সঙ্গে নিয়ে যাবেন উপযুক্ত ওষুধপত্র এবং এপিনেফ্রিন ইঞ্জেকশন। পতঙ্গের দংশনে মারাত্মক এ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যদি আপনি কোন খেলাখুলায় যোগ দেন, যে খেলাতে আপনি সচরাচর অভ্যস্ত নন বা যে খেলাতে প্রচুর শারীরিক শ্রমের দরকার হয়, সে রকম খেলার সময় নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের হিসাব রাখুন। বিশেষ করে পাহাড়ে ওঠার মতো খেলার সময় এ্যাজমা রোগীদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ৫০০০ ফিট উপরে উঠলে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কমে যায়। এছাড়া স্কি করার সময়ও এ্যাজমা রোগীদের সতর্ক থাকতে হবে। কেননা শীতল বাতাস এ্যাজমার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। সমুদ্র সৈকতে সতর্ক থাকতে হবে একজিমা রোগীদের। কারণ অতিরিক্ত রৌদ্রস্নান একজিমার প্রদাহ বাড়িয়ে দিতে পারে।
আপনার করণীয়সমূহ : যদি আপনি এ্যাজমা এবং এ্যালার্জিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে ভ্রমণ শুরুর আগে নিচের পরামর্শ মতো পরিকল্পনা তৈরি করুনÑ
* আপনার সক্রিয় এ্যালার্জি বা এ্যাজমা থাকলে ভ্রমণ শুরুর পূর্বে শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে নিন।
* প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো হাতব্যাগে বা ব্রিফকেসে রাখুন। বড় লাগেজের মধ্যে ওষুধ রাখলে দরকারের সময় ওষুধ খুঁজে বের করতে দেরি হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত পরিমাণে ওষুধ সঙ্গে নিন এবং সেগুলো ওষুধের মূল কৌটাতে রাখুন। কেননা কৌটার সঙ্গে ওষুধ নির্দেশিকা থাকে। তাছাড়া বিমান ভ্রমণের সময় মূল কৌটা সঙ্গে থাকলে কাস্টমসে আপনার ঝামেলা কম হবে।
* একটি পিক ফ্লো মিটার এবং আপনার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের ফোন নম্বর সঙ্গে রাখুন। সে সঙ্গে কাছে রাখুন ইমার্জেন্সি বা জরুরী প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো, যেমনÑএন্টিহিস্টামিন, ব্রংকো-ডাইলেটর, নিজে নিজে পুশ করার মতো এপিনেফ্রিন ইঞ্জেকশন এবং কর্টিকোস্টেরয়েড।
* বহির্দেশে ভ্রমণের সময় পোর্টেবল নেবুলাইজার সঙ্গে নিন।
* যদি টাইমজোন পার হতে হয়, তাহলে আপনার ঘড়ির সময় একই রাখুন। তাহলে নির্দিষ্ট সময় পরপর আপানর ওষুধ খেতে অসুবিধা হবে না।
* এ্যালার্জিজনিত ওষুধগুলো নিয়মিত সেবন করতে থাকুন।
* অন্য কোন দেশে যাওয়ার আগে ওয়েবসাইট থেকে সে দেশের এ্যালার্জি ও এ্যাজমা চিকিৎসা কেন্দ্রের ঠিকানা সংগ্রহ করে নিন।
* ট্রাভেল মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম চালু রাখুন। কাগজপত্র সঙ্গে নিন।
* যদি রোগের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে আপনার পূর্ব ধারণা থাকে, তাহলে আপনার ভ্রমণ হবে দুশ্চিন্তামুক্ত।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
দি এ্যালার্জি এ্যান্ড এ্যাজমা সেন্টার
৫৭/১৫ পান্থপথ, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.